Thursday 29 April 2021

Philosophy, দর্শনের প্রশ্ন উত্তর (জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি অধ্যায় থেকে)

Leave a Comment

 প্রশ্ন: সহজাত ধারণা কী? সহজাত ধারণাবাদের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলি কী কী?

অথবা 

সহজাত ধারণার স্বপক্ষে যুক্তিগুলি বিবৃত কর।

অথবা 

সহজাত ধারণা প্রসঙ্গে দেকার্তের মত আলোচনা কর।

অথবা

 লক কেমনভাবে সহজাত ধারণা নস্যাৎ করেছেন? আলোচনা কর।

অথবা 

লক কিভাবে সহজাত ধারণার অস্তিত্ব খন্ডন করেছেন তা যুক্তিসহ আলোচনা করো।

অথবা 

"আমাদের কোনো ধারণাই সহজাত নয়" ---- এই মন্তব্যটি কোন দার্শনিকের? বক্তব্যটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর।

উত্তর:

 সহজাত ধারণাবাদ: “সহজাত” বলতে বােঝায় যা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়াই নিজের দ্বারা নিজেই প্রমাণিত। এটা বুদ্ধিতেই সম্ভব। যা বুদ্ধির সাহায্যে লাভ করা যায় বা যা বুদ্ধিগম্য, তাই সহজাত। 'সহজাত' কথাটির মানে ঠিক জন্মগত বােঝায় না। সহজাত ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব বা পূর্বতসিদ্ধ(apriori)। চিন্তাক্ষেত্রে মানুষ বুদ্ধির দ্বারা কতকগুলি ধারণাকে স্পষ্ট করে তােলে। তাই সহজাত ধারণা আবশ্যিক বা নিশ্চয়ত্মক। পূর্ণতা, অসীমতা ইত্যাদির ধারণা সহজাত, তার কারণ অভিজ্ঞতা - নিরপেক্ষ অবস্থায় বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা এইসব ধারণা লাভ করতে পারি। সহজাত ধারণার ক্ষেত্রে বিপরীত চিন্তা করা যায় না। অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার ক্ষেত্রে বিপরীত চিন্তা করা যায়। আমরা একটা চেয়ারকে লােহার চেয়ার না বলে কাঠের চেয়ারও বলতে পারি। এটা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সম্ভব। কিন্তু সহজাত ধারণার ক্ষেত্রে এরকম হয় না। যেমন ডেকার্ট বলেছেন, 'আমি চিন্তা করি, আমার অস্তিত্ব আছে। এক্ষেত্রে 'আমার অস্তিত্ব নেই’ — একথা বলতে পারি না। কেননা আমি না থাকলে 'আমি চিন্তা করি’ একথা বলতে পারতাম না। এই যে আমার আত্মার ধারণা, আমার চিন্তার অস্তিত্ব এটাই বুদ্ধিগম্য ও সহজাত। সমস্ত নিত্য সত্যই সহজাত। যেমন, 'শূন্য থেকে শূন্যই সৃষ্টি হয়”, “অভাব থেকে অভাবেরই জন্ম হয়”। ঈশ্বরের ধারণা হল সহজাত। পূর্ণ সত্তা বিশিষ্ট ঈশ্বরের ধারণার কারণ ঈশ্বর নিজেই। অসীমতার ধারণা আমাদের মনে থাকে বলেই আমরা বুঝি যে আমরা সসীম।

সহজাত ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি: দেকার্ত, স্পিনােজা, লাইবনিজ প্রভৃতি বদ্ধিবাদী দার্শনিকরা অন্তর ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। ডেকার্ট ও স্পিনােজার মতে আমাদের কিছু কিছু ধারণা হল অন্তর বা সহজাত। কিন্তু লাইবনিজের মতে, আমাদের মনের সকল ধারণাই হল অন্তর বা সহজাত। অন্তর বা সহজাত ধারণা যে সম্ভব তাঁর সপক্ষে বুদ্ধিবাদীরা কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। সেগুলাে নিম্নরপ:

(১) অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার বিপরীত ভাবা যায়, কিন্তু এমন ধারণা আছে যার বিপরীত ভাবা যায় না। ২ + ২ = ৪ - এ জাতীয় জ্ঞানের বিপরীত ভাবা যায় না এবং এর সম্পর্কে কোন মতভেদ দেখা যায় না। বুদ্ধিবাদী দার্শনিকগণ বলেন , এ জাতীয় জ্ঞান বা ধারণা অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, অন্তর বা সহজাত।

 (২) অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা অভিজ্ঞতার পূর্বে থাকতে পারে না, কিন্তু কার্যকারণ সম্বন্ধ, দেশ, কাল প্রভৃতি ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব। তাই এই সকল ধারণা সহজাত। 

(৩) অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তর্কবিজ্ঞানে আমরা এমন কতকগুলি চিন্তার মূল সূত্ৰ পাই যাদের সম্বন্ধে কোনরূপ মতবিরােধ থাকতে পারে না। এগুলো অন্তর বা সহজাত অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। 

(৪) অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণতা, ঈশ্বর সম্পর্কীয়, ধারণা ও নৈতিকতা সম্পর্কীয় ধারণা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের সাহায্যে কখনও পাওয়া যায় না। এগুলো সহজাত এবং মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, বুদ্ধির সাহায্যেই এগুলো প্রকাশ্যে ব্যক্ত হয় ।

সহজাত ধারণাবাদের বিরুদ্ধে লকের যুক্তি: ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক বুদ্ধিবাদীদের সহজাত ধারণাবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে বলেন সহজাত বা অন্তর ধারণা বলে কিছু নেই। আমাদের কোন ধারনাই সহজাত নয়। এই প্রসঙ্গে লকের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ:

(১) অন্তর ধারণা যদি প্রকৃতই থাকে, তাহলে সেগুলাে সবজনস্বীকৃত হয়। কিন্তু অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণতা, কার্যকারণ সম্বন্ধীয় তথাকথিত অন্তর ধারণা সম্বন্ধে শিশু, নির্বোধ ও অশিক্ষিত ব্যক্তিরা সচেতন নয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে সর্বজন স্বীকৃত অন্তর ধারণার কোন অস্তিত্ব নেই।

 (২) অন্তর বা সহজাত ধারণা যদি অস্তিত্বশীল হয়, তাহলে সকলের মনে এই ধারণাগুলাে সমানভাবে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু ঈশ্বর, নৈতিক নিয়ম প্রভৃতি ধারণা সম্বন্ধে সকলে একই মত পোষণ করে না। বিভিন্ন দেশে ও কালে ঈশ্বর সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন ধারণার প্রচলন দেখা যায়। সুতরাং অন্তর ধারণা বলে কিছু থাকতে পারে না।

(৩) কোনো ধারণার সর্বজনীনতা প্রমাণ করে না যে সেই ধারণা হলো অন্তর বা সহজাত। আগুন সম্পর্কে সকলের মনে একই ধারণা থাকতে পারি। কিন্তু তথাপি তাকে অন্তর ধারণা বলা চলে না। কোন কোন ধারণা সকলের স্বীকৃতি লাভ করলেও তাতে প্রমাণ হয় না যে সে ধারণা অন্তর।

(৪) সহজাত ধারণা বলতে অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা বোঝায়। কিন্তু যে অবস্থার সম্বন্ধে আমাদের কোন বোধই নেই, সেইরূপ অবস্থার সহজাত ধারণার অস্তিত্ব কিভাবে মেনে নেওয়া যাবে।

(৫) চিন্তার মৌলিক নিয়মগুলি যথা- তাদাত্ম নিয়ম, বিরোধবাধক নিয়ম প্রভৃতি তথাকথিত সহজাত ধারণা সম্পর্কে সচেতন না হয়েও সাধারণ মানুষ বোঝে যে লাল ফুল লাল হবে কিংবা মা টক তার মিষ্টি হবে না ইত্যাদি। কাজেই সহজাত ধারণা বলে কিছু নেই।

এইভাবে লক সহজাত ধারণা বাদ খন্ডন করেছেন। লক বলতে চান যে, 'মনের মধ্যে এমন কিছু নেই যা পূর্বে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না।'

Read More

Wednesday 28 April 2021

A Question & Answer of Philosophy (দ্রব্য: বুদ্ধিবাদ)

Leave a Comment

 প্রশ্ন: দ্রব্য বলতে কি বুঝায়? দ্রব্যের স্বরূপ সম্বন্ধে বুদ্ধিবাদীদের অভিমত সমালোচনাসহ ব্যাখ্যা কর।

অথবা

দ্রব্য সম্পর্কে বুদ্ধিবাদের বক্তব্য কী? এই বক্তব্য কি গ্রহণযোগ্য?

অথবা

দ্রব্যের প্রকৃতি সম্বন্ধে বুদ্ধিবাদীদের বক্তব্য ব্যাখ্যা কর। এই মতবাদ কি সন্তোষজনক? বিচার কর।

উত্তর: 

দ্রব্য: নানা পরিবর্তনের মধ্যেও বস্তুর অপরিবর্তনীয় সত্তাকে দ্রব্য বলা হয়। দ্রব্য হল বস্তুর সেই সত্তা যা শত পরিবর্তনের মধ্যেও অপরিবর্তিত থাকে, যা সবকিছু ক্রিয়াশীলতার উৎস এবং যা গুণের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে। দ্রব্য হল গুণ এর আধার। দ্রব্য ঐক্য ও অখন্ডতাকে সূচিত করে।

বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে ডেকার্ট, স্পিনোজা এবং লাইবোনিজ প্রভৃতি দার্শনিকদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

 দ্রব্য সম্পর্কে বুদ্ধিবাদী মতবাদ : ডেকার্টের মত ( Descartes ) : দ্রব্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বুদ্ধিবাদী দার্শনিক ডেকার্ট বলেছেন, যাকে স্বীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপর কিছুর উপর নির্ভর করতে হয় না, তাই হল দ্রব্য। ডেকার্টের মতে স্ব - নির্ভরতা দ্রব্যের লক্ষণ। ডেকার্টের এই সংজ্ঞা মেনে নিলে একটি মাত্র দ্রব্যেরই অস্তিত্ব থাকতে পারে তা হল ঈশ্বর। ঈশ্বরই একমাত্র স্বনির্ভর দ্রব্য। কেননা, ঈশ্বর অসীম; তার বাইরে কিছু নেই। অপরদিকে, যা সসীম তা কোন - না - কোনভাবে নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য অপর বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। তাই সসীম কোন কিছুকেই ডেকার্টের সংজ্ঞা অনুযায়ী দ্রব্য আখ্যা দেওয়া যায় না। কিন্তু ডেকার্ট ঈশ্বর ছাড়া অন্য দুটি দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। এই দুটি দ্রব্য হল— মন এবং জড়। মন এবং জড় ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। কারণ, ঈশ্বরই এদের স্রষ্টা। ঈশ্বরই একমাত্র অন্য নিরপেক্ষ দ্রব্য, জড় ও মন ঈশ্বর সাপেক্ষ; তবে অন্য সমস্ত বস্তু নিরপেক্ষ। ডেকার্ট একজন দ্বৈতবাদী। দর্শনে তারাই দ্বৈবাদী হিসেবে খ্যাত যাঁরা মনে করেন যে এই জগতে দুটি মৌলিক উপাদান আছে মন ও জড় এবং জগতের সব অস্তিত্বশীল বস্তুকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়— জড়াত্মক এবং মানসিক। দ্বৈতবাদী হিসেবে ডেকার্ট বিশ্বাস করেন যে জড় ও মন পরস্পরবিরােধী দ্রব্য। তাঁর মতে মনের গুণ বা সারধর্ম  হল চেতনা এবং জড়ের গুণ বা সারধর্ম হল বিস্তৃতি। কোন অচেতন মন নেই এবং কোন বিস্তৃতিহীন জড় নেই।

     ডেকার্টের মতে দ্রব্যের অতি প্রয়ােজনীয় ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য যা অনিবার্যভাবে দ্রব্যে নিহিত থাকে তাকেই গুণ বলে। এই অতি প্রয়ােজনীয় গুণগুলি ছাড়াও কতকগুলি গৌণ গুণ বা বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলি সর্বদা দ্রব্যে উপস্থিত থাকে না। দ্রব্যের গৌণগুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলিকে ডেকার্ট প্রত্যংশ বা রূপান্তর (modes) নামে অভিহিত করেছেন। মনের গুণ হল চিন্তন। ইচ্ছা, অনুভূতি, কামনা প্রভৃতি হল মনের প্রত্যংশ বা রূপান্তর। অনুরূপভাবে, বিস্তৃতি হল জড়ের গুণ এবং অবস্থান, আকৃতি, গতি প্রভৃতি জড়ের প্রত্যংশ বা রূপান্তর। ডেকার্টের মতে ঈশ্বরের কোন প্রত্যংশ বা রূপান্তর নেই; কারণ তিনি নিত্য বা অপরিবর্তনীয়। 

      ডেকার্ট বিশ্বাস করেন, দ্রব্যের ধারণা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পাওয়া যায় না। এ ধারণা হল, অভিজ্ঞতা - পূর্ব (a - priori)। তাঁর মতে দ্রব্যের ধারণা সহজাত বা অন্তর। আমরা জন্মগ্রহণের সময় এই ধারণাগুলি নিয়ে জন্মাই। ডেকার্ট আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনে ‘সহজাত ধারণা’ ( Innate ideas ) তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা। 

স্পিনােজার (Spinoza) অভিমত: ডেকার্টের পরবর্তী দার্শনিক স্পিনােজা দ্রব্য সম্পর্কে ডেকার্টের সংজ্ঞাকেই মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি ডেকার্টের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত হতে পারলেন না। তাই ডেকাট - প্রদত্ত দ্রব্যের সংজ্ঞার সংশােধন করে স্পিনােজা দ্রব্যের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হল:  “যা নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল এবং যাকে নিজের সাহায্যেই বোঝা যায়, অর্থাৎ অপর কোন ধারণার সাহায্য না নিয়ে যার সম্পর্কে ধারণা গঠন করা যায় তাই হল দ্রব্য”। স্পিনােজার এই সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করলে বােঝা যায় যে, স্পিনােজার  মতে দ্রব্যের অপরিহার্য গুণ  দুটি— স্বনির্ভরতা  এবং স্ববেদ্যতা ( self - intelligibility )। যা অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়, তাকে বলে স্ব - নির্ভর। আর, যাকে নিজের সাহায্যেই বােঝা যায়, তা হল স্ববেদ্য। স্ব - নির্ভরতা এবং স্ববেদ্যতা— এই উভয় গুণ থাকলে, তবে, স্পিনােজার মতে, কোন বস্তুকে দ্রব্য আখ্যা দেওয়া যেতে পারে।

      স্পিনােজা বলেন যে, দ্রব্যের সংজ্ঞা থেকে অনিবার্যভাবেই কতকগুলি সিদ্ধান্ত এসে পড়ে। 

     প্রথমতঃ, দ্রব্য স্বয়ম্ভু বা নিজেই নিজের কারণ। দ্রব্যের যদি কারণ থাকত, তাহলে দ্রব্য অন্য কিছুর দ্বারা উৎপন্ন হত এবং সেক্ষেত্রে সংজ্ঞানুযায়ী তাকে দ্রব্য আখ্যা দেওয়া যেত না। দ্রব্য সম্পূর্ণ স্বাধীন। সকলের অস্তিত্ব দ্রব্যের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু দ্রব্যের অস্তিত্ব কারাের উপর নির্ভরশীল নয়।

    দ্বিতীয়তঃ, দ্রব্য অসীম। দ্রব্য অসীম বা অনন্ত না হলে একে সীমিত করতে পারে এমন আরও অন্যান্য বস্তুর সম্ভাবনা থেকে যায় এবং দ্রব্য তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েবে। 

তৃতীয়তঃ, দ্রব্য এক এবং শাশ্বত। দ্রব্য বহু হলে পরম্পর পরস্পরের দ্বারা সীমিত হয়ে পড়ত এবং স্বাধীনতা হারাত। তাছাড়া দ্রব্য শাশ্বত বা কালাতীত। যদি দ্রব্য শাশ্বত না হয়ে ক্ষণস্থায়ী হয়, তাহলে পূর্ববর্তী কোন কিছুর দ্বারা দ্রব্য উৎপন্ন হয়েছে এই সিদ্ধান্ত করতে হয়। সেক্ষেত্রে দ্রব্য অসীমত্ব হারাবে। এই এক, অদ্বিতীয়, অসীম ও স্বয়ম্ভ দ্রব্যকে স্পিনােজা ‘ঈশ্বর’ আখ্যা দিয়েছেন। আবার, তাঁর মতে ঈশ্বরই প্রকৃতি। 

স্পিনােজার দর্শনে তিনটি পদ— দ্রব্য, ঈশ্বর এবং প্রকৃতি— অভিন্ন হয়ে গেছে। ঈশ্বর কিংবা প্রকৃতি (বা বিশ্বজগৎ) থেকে দ্রব্য স্বতন্ত্র নয়; কেননা, সেক্ষেত্রে দ্রব্য আর এক থাকবে না। স্পিনােজা মনে করেন, এই দ্রব্য নির্গুণ ও নির্বিশেষ সত্তা। 

স্পিনােজা মনে করেন, মন এবং জড় দ্রব্য নয়; কেননা, এরা স্বনির্ভর নয়। মন (যার সারধর্ম চেতনা) এবং জড় (যার সারধর্ম বিস্তৃতি) ঈশ্বরের অসংখ্য গুণের মধ্যে দুটি গুণ। সমস্ত জীব ঈশ্বরের চেতনার প্রকাশ এবং সমস্ত জড়দ্রব্য ঈশ্বরের বিস্তৃতির প্রকাশ। সমুদ্র ছাড়া যেমন তরঙ্গ  অস্তিত্বশীল হতে পারে না, ঠিক তেমনভাবে ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে জীব ও জড়দ্রব্যের কোন স্বতন্ত্র সত্তা নেই। তারা মিথ্যা, মায়ামাত্র। জীবের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি নেই। জীবের কর্ম ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জড়জগতেও যা কিছু ঘটে ঈশ্বরই তার কারণ। এইভাবে স্পিনােজা বিশ্বের চরম সত্যতা অস্বীকার করলেন। 


লাইবনিজের ( Leibnitz ) অভিমত : লাইবনিজ ডেকার্ট ও স্পিনােজার মতই বিশ্বাস করেন যে, দ্রব্য তার অস্তিত্বের জন্য অন্য কোন কিছুর উপর নির্ভরশীল নয়। কিন্তু তাঁর মতে স্ব - নির্ভরতা দ্রব্যের স্বরূপ লক্ষণ নয়; দ্রব্যের স্বরূপ - লক্ষণ হল— আত্মসক্রিয়তা, বা স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করার ক্ষমতা। যা দ্রব্য তা অপরের সাহায্য ছাড়া স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করতে পারে। লাইবনিজের মতে দ্রব্য এক নয় ( যা স্পিনােজার মত ), তিন নয় ( যা ডেকার্টের মত ), দ্রব্য অসংখ্য ও অগণিত। 

লাইবনিজ বিশ্বাস করেন যে, দ্রব্য সরল বা অবিভাজ্য। এই মানদণ্ড অনুযায়ী কোন যৌগিক বস্তুকেই দ্রব্য হিসেবে স্বীকার করা যায় না। গ্রীসদেশে এক সম্প্রদায়ের দার্শনিক ছিলেন, যারা পরমাণুবাদী  নামে খ্যাত। তারা বিশ্বাস করতেন যে , জড়বস্তুকে  ক্রমাগত ভাগ করে গেলে শেষ পর্যন্ত আমরা এমন একটি ন্যূনতম অংশে পৌছাব, যাকে আর ভাগ করা যায় না। এই অবিভাজ্য অংশের নাম পরমাণু। তারা বিশ্বাস করতেন পরমাণু অবিভাজ্য, কিন্তু বিস্তৃতিসম্পন্ন। পরমাণুবাদী দার্শনিকদের মতে কেবলমাত্র অবিভাজ্য পরমাণুই দ্রব্য হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে। 

লাইবনিজ বলেন, পরমাণু কখনও অবিভাজ্য হতে পারে না। কেননা, পরমাণু বিস্তৃতিসম্পন্ন। যার বিস্তৃতি আছে, তা যত ক্ষুদ্রই হােক না কেন, অবশ্যই বিভাজ্য। বাস্তবে বিভাজ্য না হলেও কল্পনাতে বিভাজ্য। কাজেই পরমাণু দ্রব্য লাইবনিজের বক্তব্য হিসেবে স্বীকৃত হতে পারে না। লাইবনিজের বিশ্বাস হল— যে উপাদান দিয়ে বিশ্বসংসার গঠিত তা জড়াত্মক পরমাণু নয়; তা অন্য এক জাতের পরমাণু। এই পরমাণুকে লাইবনিজ 'মনাড’ (Monad) নামে অভিহিত করেছেন। আমরা মনাডের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘চিৎপরমাণু' কথাটি ব্যবহার করব। এই মনাড বা চিৎপরমাণু জগতের সমস্ত বস্তুর মূল উপাদান এবং লাইবনিজের মতে কেবলমাত্র মনাডকেই দ্রব্য বলে অভিহিত করা যায়। মনাড বা চিৎপরমাণু সংখ্যায় অগণিত। এরা যৌগিক নয়, সরল। এদের বিস্তৃতি নেই। এদের স্বভাব হল যে এরা স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করতে পারে। এরা গবাক্ষহীন; তাই এরা একে অন্যের উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। এরা অচেতন নয়, চেতন। এরা আধ্যাত্মিক বিন্দু। এরা প্রত্যেকে এক একটি শক্তিকেন্দ্র।

লাইবনিজ বলেন যে, মনাড বা চিৎপরমাণুগুলিকে তাদের শক্তি ও ক্রিয়া অনুসারে সুশৃঙ্খলভাবে সাজালে সকলের শীর্ষদেশে যে মনাড বা দ্রব্যকে পাওয়া যাবে তিনিই ঈশ্বর। লাইবনিজ বিশ্বাস করেন যে, এই অসংখ্য চিৎপরমাণু বা মনাড কাজ করে চলেছে, তাদের যিনি স্রস্টা— সেই ঈশ্বরের ইচ্ছা - সঙ্কেতে। তার ইচ্ছাতেই তারা সকলে স্বতন্ত্র স্বাধীন পথে চলেও একই সামঞ্জস্যপূর্ণ বিশ্বের অধিবাসী। লাইবনিজ মনে করেন, অনন্ত বৈচিত্র্যের ভিতর এই সামঞ্জস্য - সর্বশক্তিমান্ স্রষ্টার আদিম ইচ্ছারই অপরিহার্য ফল।


সমালােচনা : 

(১) ডেকার্টের পরবর্তী দার্শনিক স্পিনােজা  দ্রব্য সম্পর্কে ডেকার্টের সংজ্ঞাকেই মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি ডেকার্টের মতের সমালােচনা করে বললেন যে স্ব - নির্ভরতাই যদি দ্রব্যের লক্ষণ হয়, তা হলে ঈশ্বরই একমাত্র দ্রব্য। মন এবং জড় দ্রব্য হতে পারে না। কেননা, তারা ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। স্পিনােজার মতে যা সসীম এবং পরনির্ভর তা কখনই দ্রব্য হতে পারে না। 

(২) তাছাড়া, ডেকার্ট মন এবং জড়ের পৃথক অস্তিত্ব স্বীকার করে যে দ্বৈতবাদ ( dualism ) সৃষ্টি করেছেন, তা গ্রহণযােগ্য নয়। দার্শনিক মতবাদ হিসেবে দ্বৈতবাদ ক্রটিপূর্ণ। এই মতবাদের প্রধান ক্রটি হল যে, মন এবং জড় যদি বিজাতীয় দ্রব্য হয়, তাহলে তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া কিভাবে সম্ভব? যদি দুটি দ্রব্য সমজাতীয় হয়, তবেই তাদের পারস্পরিক ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়া সম্ভবপর হয়। ডেকার্টের দ্বৈতবাদের ত্রুটি দূর করতে গিয়েই স্পিনােজার অদ্বৈতবাদের ( Monism ) উদ্ভব হয় । 

      (৩) খ্যাতনামা বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজ (Leibnitz) ডেকার্ট প্রদত্ত দ্রব্যের সংজ্ঞা সম্পূর্ণভাবে মানতে চান না। তাঁর মতে স্বনির্ভরতা দ্রব্যের প্রধান লক্ষণ নয়। নিজে নিজেই ক্রিয়াশীল হওয়াটাই দ্রব্যের প্রধান লক্ষণ। তার মতে দ্রব্য অনন্ত সংখ্যক এবং দ্রব্যগুলি ক্রিয়াশীল। এই দ্রব্যকেই তিনি ‘ মনাড ’ ( Monad ) বা চিৎপরমাণু আখ্যা দিয়েছেন। এই দ্রব্যগুলি স্বয়ংশাসিত, স্বয়ংসম্পূর্ণ। 

(৪) ডেকার্টের দ্রব্যতত্ত্ব সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে না। তার কারণ, দ্রব্যের স্বরূপ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসগুলি তিনি খুঁটিয়ে দেখেননি। দ্রব্যের সঙ্গে গুণের সম্বন্ধ নিয়ে যে সমস্যা তাও তিনি ভালভাবে আলােচনা করেননি। আসলে, এই মতবাদ একটি দার্শনিক সমস্যাকে সরলীকরণের একটি বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত।


(৫) স্পিনােজার বক্তব্য নানা কারণে গ্রহণযােগ্য নয়। তিনি ঈশ্বরকে একমাত্র দ্রব্য বললেও যুক্তির সাহায্যে তা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন নি। স্পিনােজার মতে দ্রব্য হল নিবিশেষ এবং ভেদবর্জিত। এরূপ দ্রব্যের সাহায্যে জগতের বৈচিত্র্য ও পরিবর্তন ব্যাখ্যা করা যায় না। তাছাড়া দ্রব্য যদি ভেদ - বর্জিত নিবিশেষ ঐক্য হয়, তাহলে জগত্রে উৎপত্তি কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়? এর সদুত্তর পিনােজার দর্শনে পাওয়া যায় না। স্পিনােজা বলেন জড় ও মন সমপর্যায়ের। কিন্তু একথা ঠিক নয়। 

(৬) লাইবনিজ বলেন, চিৎপরমাণু বা মনাড হল দ্রব্য। এরা গবাক্ষহীন। একটি চিৎপরমাণ; আর একটির ওপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ঈশ্বর হলেন  সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎ পরমাণ। তাহলে ঈশ্বর অন্য কোন চিৎপরমাণুর ওপর কিভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন? এর উত্তর লাইবনিজ দিতে পারেন না। লাইবনিজের চিৎপরমাণ; বােধগম্য নয়। এরপ বিষয়ের অনুভব সম্ভব নয়। চিৎপরমাণ  যৌগিক জড়বস্তর ব্যাখ্যা সঙ্গতভাবে দিতে পারে না। লাইবনিজ বহুত্ববাদী। তিনি বহুত্ব ঐক্যের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধান করতে পারেন নি। তাঁর মতবাদ আত্মবিরােধিতায় পরিপূর্ণণ। 

 সুতরাং দেখা যাচ্ছে বুদ্ধিবাদীদের দ্রব্য সম্পর্কে মতবাদ সন্তোষজনক নয়। প্রত্যেকের বক্তব্যের মধ্যেই কোন না কোন এটি আছে।

Read More