Thursday 29 April 2021

Philosophy, দর্শনের প্রশ্ন উত্তর (জ্ঞানের স্বরূপ বা প্রকৃতি অধ্যায় থেকে)

Leave a Comment

 প্রশ্ন: সহজাত ধারণা কী? সহজাত ধারণাবাদের স্বপক্ষে ও বিপক্ষে প্রধান যুক্তিগুলি কী কী?

অথবা 

সহজাত ধারণার স্বপক্ষে যুক্তিগুলি বিবৃত কর।

অথবা 

সহজাত ধারণা প্রসঙ্গে দেকার্তের মত আলোচনা কর।

অথবা

 লক কেমনভাবে সহজাত ধারণা নস্যাৎ করেছেন? আলোচনা কর।

অথবা 

লক কিভাবে সহজাত ধারণার অস্তিত্ব খন্ডন করেছেন তা যুক্তিসহ আলোচনা করো।

অথবা 

"আমাদের কোনো ধারণাই সহজাত নয়" ---- এই মন্তব্যটি কোন দার্শনিকের? বক্তব্যটির যথার্থতা বিশ্লেষণ কর।

উত্তর:

 সহজাত ধারণাবাদ: “সহজাত” বলতে বােঝায় যা ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার সাহায্য ছাড়াই নিজের দ্বারা নিজেই প্রমাণিত। এটা বুদ্ধিতেই সম্ভব। যা বুদ্ধির সাহায্যে লাভ করা যায় বা যা বুদ্ধিগম্য, তাই সহজাত। 'সহজাত' কথাটির মানে ঠিক জন্মগত বােঝায় না। সহজাত ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব বা পূর্বতসিদ্ধ(apriori)। চিন্তাক্ষেত্রে মানুষ বুদ্ধির দ্বারা কতকগুলি ধারণাকে স্পষ্ট করে তােলে। তাই সহজাত ধারণা আবশ্যিক বা নিশ্চয়ত্মক। পূর্ণতা, অসীমতা ইত্যাদির ধারণা সহজাত, তার কারণ অভিজ্ঞতা - নিরপেক্ষ অবস্থায় বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা এইসব ধারণা লাভ করতে পারি। সহজাত ধারণার ক্ষেত্রে বিপরীত চিন্তা করা যায় না। অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার ক্ষেত্রে বিপরীত চিন্তা করা যায়। আমরা একটা চেয়ারকে লােহার চেয়ার না বলে কাঠের চেয়ারও বলতে পারি। এটা অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে সম্ভব। কিন্তু সহজাত ধারণার ক্ষেত্রে এরকম হয় না। যেমন ডেকার্ট বলেছেন, 'আমি চিন্তা করি, আমার অস্তিত্ব আছে। এক্ষেত্রে 'আমার অস্তিত্ব নেই’ — একথা বলতে পারি না। কেননা আমি না থাকলে 'আমি চিন্তা করি’ একথা বলতে পারতাম না। এই যে আমার আত্মার ধারণা, আমার চিন্তার অস্তিত্ব এটাই বুদ্ধিগম্য ও সহজাত। সমস্ত নিত্য সত্যই সহজাত। যেমন, 'শূন্য থেকে শূন্যই সৃষ্টি হয়”, “অভাব থেকে অভাবেরই জন্ম হয়”। ঈশ্বরের ধারণা হল সহজাত। পূর্ণ সত্তা বিশিষ্ট ঈশ্বরের ধারণার কারণ ঈশ্বর নিজেই। অসীমতার ধারণা আমাদের মনে থাকে বলেই আমরা বুঝি যে আমরা সসীম।

সহজাত ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি: দেকার্ত, স্পিনােজা, লাইবনিজ প্রভৃতি বদ্ধিবাদী দার্শনিকরা অন্তর ধারণার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। ডেকার্ট ও স্পিনােজার মতে আমাদের কিছু কিছু ধারণা হল অন্তর বা সহজাত। কিন্তু লাইবনিজের মতে, আমাদের মনের সকল ধারণাই হল অন্তর বা সহজাত। অন্তর বা সহজাত ধারণা যে সম্ভব তাঁর সপক্ষে বুদ্ধিবাদীরা কয়েকটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। সেগুলাে নিম্নরপ:

(১) অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণার বিপরীত ভাবা যায়, কিন্তু এমন ধারণা আছে যার বিপরীত ভাবা যায় না। ২ + ২ = ৪ - এ জাতীয় জ্ঞানের বিপরীত ভাবা যায় না এবং এর সম্পর্কে কোন মতভেদ দেখা যায় না। বুদ্ধিবাদী দার্শনিকগণ বলেন , এ জাতীয় জ্ঞান বা ধারণা অভিজ্ঞতালব্ধ নয়, অন্তর বা সহজাত।

 (২) অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা অভিজ্ঞতার পূর্বে থাকতে পারে না, কিন্তু কার্যকারণ সম্বন্ধ, দেশ, কাল প্রভৃতি ধারণা অভিজ্ঞতাপূর্ব। তাই এই সকল ধারণা সহজাত। 

(৩) অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু তর্কবিজ্ঞানে আমরা এমন কতকগুলি চিন্তার মূল সূত্ৰ পাই যাদের সম্বন্ধে কোনরূপ মতবিরােধ থাকতে পারে না। এগুলো অন্তর বা সহজাত অভিজ্ঞতালব্ধ নয়। 

(৪) অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণতা, ঈশ্বর সম্পর্কীয়, ধারণা ও নৈতিকতা সম্পর্কীয় ধারণা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষের সাহায্যে কখনও পাওয়া যায় না। এগুলো সহজাত এবং মনের মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, বুদ্ধির সাহায্যেই এগুলো প্রকাশ্যে ব্যক্ত হয় ।

সহজাত ধারণাবাদের বিরুদ্ধে লকের যুক্তি: ব্রিটিশ দার্শনিক জন লক বুদ্ধিবাদীদের সহজাত ধারণাবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করে বলেন সহজাত বা অন্তর ধারণা বলে কিছু নেই। আমাদের কোন ধারনাই সহজাত নয়। এই প্রসঙ্গে লকের যুক্তিগুলি নিম্নরূপ:

(১) অন্তর ধারণা যদি প্রকৃতই থাকে, তাহলে সেগুলাে সবজনস্বীকৃত হয়। কিন্তু অসীমতা, নিত্যতা, পূর্ণতা, কার্যকারণ সম্বন্ধীয় তথাকথিত অন্তর ধারণা সম্বন্ধে শিশু, নির্বোধ ও অশিক্ষিত ব্যক্তিরা সচেতন নয়। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে সর্বজন স্বীকৃত অন্তর ধারণার কোন অস্তিত্ব নেই।

 (২) অন্তর বা সহজাত ধারণা যদি অস্তিত্বশীল হয়, তাহলে সকলের মনে এই ধারণাগুলাে সমানভাবে উপস্থিত থাকবে। কিন্তু ঈশ্বর, নৈতিক নিয়ম প্রভৃতি ধারণা সম্বন্ধে সকলে একই মত পোষণ করে না। বিভিন্ন দেশে ও কালে ঈশ্বর সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন ধারণার প্রচলন দেখা যায়। সুতরাং অন্তর ধারণা বলে কিছু থাকতে পারে না।

(৩) কোনো ধারণার সর্বজনীনতা প্রমাণ করে না যে সেই ধারণা হলো অন্তর বা সহজাত। আগুন সম্পর্কে সকলের মনে একই ধারণা থাকতে পারি। কিন্তু তথাপি তাকে অন্তর ধারণা বলা চলে না। কোন কোন ধারণা সকলের স্বীকৃতি লাভ করলেও তাতে প্রমাণ হয় না যে সে ধারণা অন্তর।

(৪) সহজাত ধারণা বলতে অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা বোঝায়। কিন্তু যে অবস্থার সম্বন্ধে আমাদের কোন বোধই নেই, সেইরূপ অবস্থার সহজাত ধারণার অস্তিত্ব কিভাবে মেনে নেওয়া যাবে।

(৫) চিন্তার মৌলিক নিয়মগুলি যথা- তাদাত্ম নিয়ম, বিরোধবাধক নিয়ম প্রভৃতি তথাকথিত সহজাত ধারণা সম্পর্কে সচেতন না হয়েও সাধারণ মানুষ বোঝে যে লাল ফুল লাল হবে কিংবা মা টক তার মিষ্টি হবে না ইত্যাদি। কাজেই সহজাত ধারণা বলে কিছু নেই।

এইভাবে লক সহজাত ধারণা বাদ খন্ডন করেছেন। লক বলতে চান যে, 'মনের মধ্যে এমন কিছু নেই যা পূর্বে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না।'

If You Enjoyed This, Take 5 Seconds To Share It

0 comments: