Sunday 8 January 2023

চার্বাক দর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ( Give a brief sketch of Carvaka Philosophy. )

Leave a Comment

 চার্বাক দর্শনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ( Give a brief sketch of Carvaka Philosophy. ) 


উঃ: ভারতীয় দর্শনে চার্বাক মত হল বিশুদ্ধ জড়বাদ। যে মতবাদে অচেতন জড় পদার্থই একমাত্র  তত্ত্ব এবং প্রাণ, মন, চৈতন্য প্রভৃতি জড় থেকেই উদ্ভূত, আত্মা ও ঈশ্বরকে স্বীকার করা হয় না; সেই মতবাদই হল জড়বাদ।


চার্বাক দর্শন যে অতিপ্রাচীন এ বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। প্রাচীন মহাকাব্যে---রামায়ণ, মহাভারতের বিভিন্ন জায়গায়, বেদ ও বৌদ্ধ সাহিত্যে চার্বাক দর্শনের পরিচয় পাওয়া যায়। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন দার্শনিকগণ চার্বাক মতবাদ খণ্ডন করেছেন ও তাদের দর্শনের বিভিন্ন গ্রন্থে এই মতবাদের উল্লেখ রয়েছে। মনুসংহিতায়, বৌদ্ধগ্রন্থ "মঝ্ ঝিমনিকায়ে শংকরের 'বেদান্ত সূত্রভাষ্য গ্রন্থে চার্বাক মতের পরিচয় মেলে। প্রাচীন ভারতীয় চিন্তাধারায় যে জড়বাদী উপাদান নৈতিক, ধর্মীয়, রাজনীতিগত কারণে প্রসুপ্ত ছিল, চার্বাক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় তা এক নিটোল জড়বাদী দর্শনের রূপ পরিগ্রহ করেছিল।


চার্বাক দর্শনের প্রবর্তকরূপে ঋগ্বেদের ঋষি বৃহস্পতিলৌক্য বা ব্রহ্মণস্পতির নাম কোন কোন গ্রন্থে পাওয়া যায়৷ কথিত আছে অসুরদের মধ্যে বিভ্রান্তি আনার চেষ্টায় দেবতাদের গুরু বৃহস্পতি এই দর্শনকে ব্যাপ্ত করেন। এই বৃহস্পতির যে কি পরিচয় তা এখনও নির্ণীত হয়নি। কারও কারও মতে, 'চার্বাক' শব্দের উৎপত্তি হয় 'চর্ব ধাতু থেকে। 'চর্ব' অর্থ চর্বণ করা (খাওয়া)। চার্বাক দর্শন খাওয়া-দাওয়া, পান- ভোজনকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করতেন। আবার কারও কারও ধারণা 'চার্বাক শব্দটির অর্থ হল চারু + বাক্ অর্থাৎ চারুবাক' বা মধুর বাক্য। মধুর কথা শোনায় বলেই জড়বাদীদের নাম হয়েছে চার্বাক। ঈশ্বর নেই, আত্মা নেই, জড়ই চরম তত্ত্ব, প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ—এ সবই মিষ্টি কথার ঢেউ এবং সে যুগে এগুলি সাধারণের মধ্যে প্রচণ্ড সাড়া জাগিয়েছিল।


প্রকৃতপক্ষে চার্বাক দর্শনের কোন প্রামাণ্য গ্রন্থ আজও পাওয়া যায়নি। তার ফলে এ দর্শনের যে কে প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা, তা নির্ধারণ করা এখনও সম্ভব হয়নি। যাই হোক, সাধারণ মানুষের কাছে চার্বাক দর্শনের জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যায়। দর্শনের গভীর তত্ত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত। আধ্যাত্মিক জগতের বিরাট ভাব ও বাণী তাদের কাছে অসার ও অর্থহীন। সাধারণভাবে বুঝবার পক্ষে যে মতবাদ, তারই আকর্ষণ তাদের কাছে সর্বাধিক। সাধারণ চিন্তাধারার উপর ভিত্তি করে রচিত চার্বাক দর্শন তাই 'লোকায়ত দর্শন' নামে চিহ্নিত হয়েছে।


চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ। অনুমান বিশ্বাসযোগ্য নয়। অতএব অনুমান কোন প্রমাণই নয়। শব্দ প্রমাণও অনুমান-নির্ভর বলে বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। চার্বাকগণ বলেন, সে বস্তুরই অস্তিত্ব আছে, যাকে ইন্দ্রিয়ের দ্বারা প্রত্যক্ষ করা যায়। যা ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষলব্ধ নয়, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। চার্বাকদের মতে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে বাইরের বস্তুর সাক্ষাৎ জ্ঞান হয় তা হল বাহ্যিক প্রত্যক্ষ। মনের সাহায্যে সুখ, দুঃখ প্রভৃতি মানসিক অবস্থার যে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ হয় তাকে বলা হয় 'মানস প্রত্যক্ষ'।


চার্বাক মতে জড় পদার্থই পরম তত্ত্ব। চারটি মহাভূতের অস্তিত্ব আছে। এই চার রকম মহাভূতের সংযোগ-বিয়োগেই বিশ্বের যাবতীয় পদার্থের উৎপত্তি-বিলুপ্তি ঘটে। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চার মহাভূতের সংযোগেই জগতের সৃষ্টি সম্ভার। আকাশভরা সূর্য, তারা, গ্রহ, চন্দ্র বিশ্বভরা বৃক্ষলতা, জীব অবয়ব, মানব শরীর, — এসব কিছুরই চার মহাভূত থেকে আবির্ভাব ও চার মহাভূতেই তিরোভাব।


চার্বাক সম্প্রদায় চেতনার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। চৈতন্য দেহের একটি গুণ। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ এই চারটি মহাভূতের যে কোন একটির মধ্যে এই গুণটি যদিও থাকে না, এই চারটি মহাভূত নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশ্রিত হলে যে দেহের উৎপত্তি হয়, সেই দেহে এই নতুন গুণ চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে। চার্বাকগণের মতে, পান, সুপারি, চুন—এই তিন বস্তুর কোনটিতেই লাল রঙ বা আভা নেই, কিন্তু একসঙ্গে নির্দিষ্ট পরিমাণে ঐ তিনটি বস্তুকে মিশিয়ে চিবোলে লাল রঙ দেখা যায়। ঠিক তেমনই ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ-এই চার মহাভূতের কোনটিতেই চৈতন্য না থাকলেও এগুলির নির্দিষ্ট পরিমাণ সংমিশ্রণে চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটে। জড়েরই উপরন্ত হল চৈতন্য। 


চার্বাকগণ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তাঁদের মতে, দেহের অতিরিক্ত আত্মার কোন  সত্তা নেই। চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই হল আত্মা। দেহ ও আত্মা অভিন্ন। দেহের বিনাশে আত্মারও বিনাশ ঘটে। 

চার্বাকগণের মতে, পরজন্ম একটি ভ্রান্ত ধারণা। বর্তমান জীবনই সত্য। চার্বাকগণ আত্মার অমরতায় বিশ্বাসী নন। তাঁরা কর্মফল ভোগকেও হেসে উড়িয়ে দেন। মানুষ এ জন্মে ভাল কাজ করলে পরের জন্মে দারুণ সুখ ভোগ করবে আর এ জন্মে খারাপ কাজ করলে পরের জন্মে দারুণ দুঃখ ভোগ করবে—এসব কথা অর্থহীন ও অযৌক্তিক।


ভারতীয় দর্শনের অনেক সম্প্রদায়ই মোক্ষের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন। অনেক ভারতীয় দার্শনিক স্বীকার করেন মোক্ষলাভ করাই মানবজীবনের পরম আদর্শ। মোক্ষ পর্যায়ে চার্বাকগণের ঘোরতর আপত্তি। তাদের বক্তব্য হল, যদি আত্মারই কোন সত্তা না থাকে, তাহলে আত্মার আবার মুক্তি কি? আত্মার মুক্তি ভ্রান্ত ধারণাভিত্তিক।


চার্বাকগণ বেদ-বিশ্বাসী নন। তাঁরা মনে করেন ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। জগৎ সৃষ্টির সহায়ক ঈশ্বর নন, চার মহাভূতের স্বাভাবিক সংমিশ্রণেই জগৎ সৃষ্টি হয়েছে। পুরোহিতরাই  ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে জীবিকা অর্জনের তাগিদে সাধারণ মানুষকে ঈশ্বর আরাধনা করার জন্য অনুপ্রাণিত করেন। ঈশ্বর নেই। ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। যা প্রত্যক্ষ করা যায় না তার অস্তিত্বেও বিশ্বাস করা যায় না। চার্বাকগণ মনে করেন, বিশ্বে যা কিছু ঘটছে তাই স্বাভাবিক। জড় উপাদানের স্বাভাবিক পরিণতি এই জগৎ। জগৎ সৃষ্টির পেছনে কোন সচেতন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না।


চার্বাক মতে, ইন্দ্রিয় সুখই মানব জীবনের পরম আদর্শ। ধর্ম নয়, মোক্ষ নয়, কাম ও অর্থই হল মুখ্য ও গৌণ পুরুযার্থ। সুখই স্বর্গ। সুখ লাভ করাই জীবের চরম উদ্দেশ্য। এ জীবনে যে সবচেয়ে বেশি সুখ লাভ করতে পারে তারই তো সাধু জীবন। পরজন্মে সুখ পায় বলে যারা এজন্মে কৃচ্ছ্রসাধনা করে তাদের মত বোকা আর কেউ নেই। চার্বাকদের বিখ্যাত উক্তিও "যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ, ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” অর্থাৎ "যতদিন বাঁচ সুখে বাঁচ, ঋণ করেও ঘি খাও। চার্বাকদের বক্তব্য, বেঁচে থাকা তো সুখে দুঃখেই। দুঃখ আছে বলে কি কেউ সুখ চাইবে না ? মাছে কাঁটা আছে বলে কি কেউ মাছ খাবে না? দুঃখ মিশে আছে বলে বর্তমান সুখকে পরিহার করা মানুষের পক্ষে বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। জীবের সুখ ও শান্তি নির্ভর করে জৈবিক প্রবৃত্তির যথেচ্ছ রূপায়ণের উপর।

If You Enjoyed This, Take 5 Seconds To Share It

0 comments: