পাশ্চাত্য দর্শন
একাদশ শ্রেণী (wbchse)
দ্বিতীয় অধ্যায়
জ্ঞানের প্রকৃতি এবং জ্ঞান সম্পর্কীয় মতবাদ
প্রশ্ন: জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে কান্টের বিচারবাদ সবিচার আলোচনা কর। ( Discuss Kan't critical theory as a source of knowledge.) ৮
উত্তর:
ভূমিকা: জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে পাশ্চাত্য দর্শনে যে সব মতবাদগুলির সন্ধান পাওয়া যায় তার মধ্যে বিচারবাদ হল অন্যতম। জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট হলেন বিচার বাদের প্রবর্তক। জ্ঞানের উৎস ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ - উভয় মতবাদই যে ত্রুটিপূর্ণ এবং নির্বিচারভাবে কিছু বিষয়কে স্বীকার করে নেয় তা কান্ট তাঁর বিচারবাদে আলোচনা করে দেখিয়েছেন।
সমন্বয়মূলক মতবাদ: বুদ্ধিবাদ অনুযায়ী বুদ্ধি হল যথার্থ জ্ঞানের উৎস। অন্যদিকে অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী অভিজ্ঞতাই জ্ঞানের একমাত্র পথ। কান্টের মতে, জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধি দুইয়েরই প্রয়োজন আছে। উভয় মতবাদই আংশিক সত্য, কিন্তু কোনটাই সম্পূর্ণ দোষমুক্ত নয়। কান্ট নিরপেক্ষভাবে ইন্দ্রিয়ানুভব ও বুদ্ধির সামর্থ্য, জ্ঞানের শর্ত, সীমা ও সম্ভাবনা ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করে অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধির সমন্বয়ে জ্ঞানের উৎপত্তির কথা বলেছেন। এই জন্য কান্টের মতবাদকে বিচারবাদ বলা হয়।
জ্ঞানের উৎস: কান্টের মতে জ্ঞানের দুটি দিক - একটি হল উপাদান অপরটি হল আকার। অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা জ্ঞানের উপাদান পাই। আর বুদ্ধির মাধ্যমে পাই জ্ঞানের আকার। জ্ঞানের উপাদান হলো সংবেদন এবং তা আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ। এই সংবেদনগুলি বিশৃঙ্খল এবং অবিন্যস্ত অবস্থায় থাকে। তাই সংবেদনগুলি জ্ঞান নয়। বুদ্ধি যখন এই বিশৃঙ্খল সংবেদন বা উপাদানগুলির উপর তার আকার আরোপ করে তখনই তা জ্ঞানে পরিণত হয়। জ্ঞানের আকার হলো ছাঁচ যাতে না-সাজালে মানুষের মন সংবেদনগুলির তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারে না। কান্টের মতে, জ্ঞানের আকার দু'প্রকার - ইন্দ্রিয়ানুভূতির আকার এবং বোধজাত আকার। দেশ ও কালকে বলা হয় ইন্দ্রিয়ানুভূতির পূর্বতঃসিদ্ধ আকার। বাহ্য জগত থেকে পাওয়া সংবেদনগুলি যখন দেশগত ও কালগত আকার নিয়ে মনের কাছে উপস্থিত হয় তখন মন তার উপর কতগুলি বোধজাত আকার আরোপ ক'রে তাকে সুবিন্যস্ত ও সুসংবদ্ধ করে তখনই জ্ঞান উৎপন্ন হয়। তাই কান্ট বলেন, "আকার ছাড়া শুধু উপাদান অন্ধ এবং উপাদান ছাড়া শুধু আকার শূন্যগর্ভ" (intuitions without concepts are blind and concept without intuitions are empty.)।
্জ্ঞানের স্বরূপ: কান্টের মতে, প্রকৃত জ্ঞানের দুটি বৈশিষ্ট্য থাকবে-- অনিবার্যতা ও নতুনত্ব। যে জ্ঞানে শুধু নতুনত্ব আছে অথচ অনিবার্যতা নেই তা প্রকৃত জ্ঞান নয়। আবার অনিবার্যতা আছে নতুনত্ব নেই এমন জ্ঞানকে প্রকৃত জ্ঞান বলা যাবে না। প্রকৃত জ্ঞান হবে অনিবার্য ও তথ্য বিষয়ক। প্রকৃত জ্ঞান জগতের ব্যাপার বিষয়ক হবে। আবার নিত্য সত্য হবে এবং সে ক্ষেত্রে বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা উভয়েরই সমন্বয় প্রয়োজন।
অবভাস ও বস্তু-স্বরূপ: কান্টের মতে, বস্তুর দুটি রূপ আছে-- একটি হলো অবভাস বা বাহ্য রূপ এবং অপরটি হলো বস্তু-স্বরূপ বা তত্ত্ব। আমাদের সামনে বস্তুটি যেভাবে প্রকাশিত হয় সেটি হলো অবভাস। আর বস্তু-স্বরূপ হলো বস্তুর আসল রূপ। আমরা অবভাসের জ্ঞানই পেয়ে থাকি। বস্তু-স্বরূপের জ্ঞান আমাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়। অথচ বস্তূ-স্বরূপকে স্বীকার করতেই হয়। জ্ঞানের বিষয় সম্পর্কে যে পরিচয় আমরা সংবেদনের মাধ্যমে পাই তার নাম হলো অনুভব। এই অনুভবের উৎস হল বস্তু-স্বরূপ। তাই বস্তু-স্বরূপের অস্তিত্ব মানতেই হয়। আর এই বস্তু-স্বরূপ বা অতীন্দ্রিয় সত্তা চিরকালই অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় থাকে।
সমালোচনা: বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদ অপেক্ষা কান্টের বিচারবাদ অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তবুও এই মতবাদ ত্রুটিমুক্ত নয়।
১) জ্ঞানের আকার ও উপাদান ভিন্নধর্মী। জ্ঞানের আকার হল বুদ্ধি আর জ্ঞানের উপাদান হলো সংবেদন। কান্টের মতে, বুদ্ধি ও সংবেদনের সংমিশ্রণে জ্ঞানের উৎপত্তি হয়। কিন্তু বুদ্ধির সক্রিয়তা ও সংবেদনের নিষ্ক্রিয়তা এই দুই বিজাতীয় প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয় কিভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের উত্তর কান্টের মতবাদে পাওয়া যায় না।
২) কান্ট অবভাস ও বস্তূ-স্বরূপের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে, বস্তু- স্বরূপ অজ্ঞাত এবং অজ্ঞেয়। তাই কান্টের বিচারবাদ অজ্ঞেয়বাদে পর্যবসিত হয়েছে।
৩) 'আমরা কেবল বস্তুর অবভাসকেই জানি, বস্তু-স্বরূপ সম্পকে জানতে পারি না'। কান্টের একথা যুক্তিহীন। কেননা, সত্তা ও তার অবভাস দুটি বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। উভয়ে মিলে এক সম্পূর্ণ সত্য গঠিত হয়।
<<<<<>>>>>