জ্ঞান সম্পর্কিত তত্ত্ব
দ্বিতীয় অধ্যায়
একাদশ শ্রেণি (wbchse)
প্রশ্ন: জ্ঞানের উৎস ও স্বরূপ সম্পর্কে লকের মতবাদ সবিচার আলোচনা কর।(Critically discuss Locke's view regarding the sources and nature of knowledge.)
দ্বিতীয় অধ্যায়
একাদশ শ্রেণি (wbchse)
প্রশ্ন: জ্ঞানের উৎস ও স্বরূপ সম্পর্কে লকের মতবাদ সবিচার আলোচনা কর।(Critically discuss Locke's view regarding the sources and nature of knowledge.)
OR, জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বার্কলের মতবাদ সবিচার আলোচনা কর।( Critically discuss Barkeley's view regarding the sources of knowledge.)
OR, জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে হিমের মতবাদ সবিচার আলোচনা কর।(critically discuss Hume's view regarding the sources of knowledge.)
OR, জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে অভিজ্ঞতাবাদ সবিচার আলোচনা কর। (Critically discuss the Empiricism regarding the sources of knowledge.)
উত্তর:
ভূমিকা: অভিজ্ঞতাবাদ অনুসারে ইন্দ্রিয় সংবেদন তথা অভিজ্ঞতাই হলো যাবতীয় জ্ঞানের একমাত্র উৎস। এই মত যাঁরা সমর্থন করেন তাঁদের অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক বলা হয়। প্রাচীন যুগের অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হলেন প্রোটাগোরাস, এরিস্টিপাস, গর্জিয়াস প্রমুখ। এঁদের মতে, অভিজ্ঞতাই জ্ঞান লাভের একমাত্র উৎস। আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসে তিনজন উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক হলেন জন লক, জর্জ বার্কলে এবং ডেভিড হিউম।
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে লকের মতবাদ: দার্শনিক লকই এই অভিজ্ঞতাবাদের একটি সুসংহত ও সুস্পষ্ট রূপ দান করেন। তিনি দার্শনিক দেকার্তের অন্তর বা সহজাত ধারণা সম্পর্কীয় মতবাদের তীব্র সমালোচনা করেন ও তার বিরুদ্ধে কতগুলি যুক্তি দেন।
লকের মতে, জন্মমুহূর্তে আমরা কোন সহজাত ধারণা নিয়ে আসি না। জন্মগ্রহনের সময় মানুষের মন থাকে এক টুকরো অলিখিত সাদা কাগজের মতো, যাকে লক 'tabularasa' বলেছেন। যেখানে কোনো ধারণার চিহ্নমাত্র থাকে না। যাবতীয় সকল ধারণা তথা জ্ঞানের উৎস হল অভিজ্ঞতা। সংবেদন ও অন্তর্দর্শন এর সাহায্যে মনে সকল প্রকার ধারণার উৎপত্তি হয়। সংবেদনের সাহায্যে আমরা বাহ্য জগতের বিভিন্ন বস্তু যেমন- উত্তাপ, কাঠিন্য, বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা পাই। আর অন্তর্দর্শন বা অন্তঃপ্রত্যক্ষে আমরা বিভিন্ন মানসিক অবস্থা অর্থাৎ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা পাই। সংবেদন ও অন্তর্দর্শন ছাড়া অন্য কোন পথ বেয়ে মনে ধারণার উৎপত্তি হতে পারে না। এই ধারণা লাভের ক্ষেত্রে আমাদের মন থাকে একেবারেই নিষ্ক্রিয়। আমাদের অভিজ্ঞতা যেভাবে ধারণাকে আমাদের মনে মুদ্রিত করে আমরা সেগুলিকে ঠিক সেইভাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হই। আমাদের মনে কোন অভিজ্ঞতাপূর্ব ধারণা থাকে না। এ প্রসঙ্গে লক এর বিখ্যাত উক্তি হলো "বুদ্ধিতে এমন কিছু নেই যা পূর্বে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ছিল না" কাজেই আমাদের সমস্ত প্রকার ধারণাই অভিজ্ঞতালব্ধ।
লক ধারনাকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন-- সরল ধারণা ও জটিল ধারণা। সংবেদন ও অন্তর দর্শনের মাধ্যমে আমরা সরল ধারণা গুলিকে লাভ করি। বিভিন্ন সরল ধারণাগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে তুলনা ও সংযুক্ত করে মন কতগুলি ধারনা গঠন করে সেগুলি হল জটিল ধারণা। লকের মতে, ধারণা জ্ঞান নয়। ধারণার মধ্যে মিল ও অমিল প্রত্যক্ষ করাই জ্ঞান।
লকের মতে, আমরা ধারণাকে প্রত্যক্ষভাবে জানি এবং ধারণার মাধ্যমে পরোক্ষভাবে বস্তুকে জানি। তিনি বলেন যে অভিজ্ঞতায় আমরা বস্তুর গুণগুলোকে প্রত্যক্ষ করি। গুণগুলি পরিবর্তনশীল। এগুলি আপনা আপনি থাকতে পারে না। গুণগুলির আধার রূপে তিনি দ্রব্যকে স্বীকার করেছেন। সেরূপ চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছার আধার রূপে তিনি আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। জগতের সৃষ্টিকর্তা রূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমরা অনুমান করি, এগুলোর কোনটাই প্রত্যক্ষলব্ধ নয়।
সমালোচনা: জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে লকের মতবাদ সংগতিসম্পন্ন নয়। কেননা- তাঁর মতবাদে নিম্নলিখিত ত্রুটিগুলি বর্তমান।
১) লক অভিজ্ঞতাপূর্ব সহজাত ধারণার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। কিন্তু মানুষের মনে সহজাত ধারণা না থাকলেও সহজাত প্রবণতা যে আছে তা অস্বীকার করা যায় না।
২) লক বলেন, মন নিষ্ক্রিয়ভাবে ধারণাগুলিকে গ্রহণ করে। কিন্তু জ্ঞানের ব্যাপারে মন নিষ্ক্রিয় থাকে না, বরং; সক্রিয় থাকে।
৩) লক অভিজ্ঞতাবাদী হয়েও জড়দ্রব্য, আত্মা ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন, যা তাঁর অভিজ্ঞতাবাদী মতের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ।
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বার্কলের মতবাদ: লককে অনুসরণ করে বার্কলে বলেন, আমাদের সমস্ত জ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা থেকে। জ্ঞানের মূল উপাদান হলো ধারনা। আমরা কেবল ধারণাকেই প্রত্যক্ষ করি। তিনি বলেন, কেবলমাত্র মন ও মনের ধারণারই অস্তিত্ব আছে। বাহ্যবস্তুর কোন পৃথক সত্তা নেই। যে কোন বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে মনের উপর বা প্রত্যক্ষের উপর। বার্কলে আরো বলেন, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যেখানে জ্ঞানের একমাত্র উপায় সেখানে বস্তুর পৃথক সত্তার অস্তিত্ব আমরা স্বীকার করতে পারি না। কেননা, বস্তুর সত্তা প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। বার্কলের মতে, বস্তুর অস্তিত্ব ব্যক্তি মনের উপর নির্ভর করে না, নির্ভর করে ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের উপর। এইভাবে বার্কলে জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও আত্মা বা মন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন।
সমালোচনা: জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে বার্কলের মতবাদ সন্তোষজনক নয়। কেননা- তার মতবাদে নিম্নলিখিত ত্রুটিগুলি বর্তমান।
১) বার্কলে জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেন বস্তুজগৎ ব্যক্তিমনের ধারণামাত্র। কিন্তু বার্কলের এইরূপ বক্তব্যের অনিবার্য পরিণতি হল অহংসর্বস্ববাদ।
২) যে সকল যুক্তির সাহায্যে বার্কলে জড়দ্রব্যের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন সেই একই যুক্তিতে ঈশ্বর এবং আত্মার অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা যায়।
জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে হিউমের মতবাদ: লক ও বার্কলের মতো ডেভিড হিউম একজন অভিজ্ঞতাবাদী দার্শনিক। কিন্তু লক ও বার্কলের অভিজ্ঞতাবাদের চেয়ে হিউমের অভিজ্ঞতাবাদ অনেক বেশি সঙ্গতিপূর্ণ। হিউমের মতে, আমাদের যাবতীয় জ্ঞানের উদ্ভব ঘটে মুদ্রণ ও ধারণা থেকে। এ দুটি হচ্ছে জ্ঞানের একমাত্র উপাদান বা উপকরণ। হিউম মুদ্রণ বলতে বাহ্য ও আন্তর সংবেদনকেই বুঝিয়েছেন। আমাদের চক্ষু, কর্ণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয় যখন কোন বস্তুর সংস্পর্শে আসে তখন সেই বস্তুর একটা ছাপ আমাদের মনে পড়ে। হিউম তারই নাম দিয়েছেন মুদ্রণ। আর ধারণা হলো মুদ্রণের অস্পষ্ট ও ক্ষীণ মানসরূপ। আসলে মুদ্রণ ও ধারণার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল মুদ্রণ স্পষ্ট ও সজিব। কিন্তু ধারণা হলো মুদ্রণের অস্পষ্ট ও নির্জীব অনুলিপি বা প্রতিরূপ। হিউম বলেন, মুদ্রণ ছাড়া ধারণা সৃষ্টি হতে পারে না। প্রতিটি ধারণার অনুরূপ মুদ্রন আছে।
হিউম কোন দ্রব্যের অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। তার মতে দ্রব্য, আত্মা এবং ঈশ্বর প্রভৃতি সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা হতে পারে না। কেননা, এইগুলির প্রতিটি অতীন্দ্রিয় এবং এদের কোনটির সম্পর্কে আমাদের সংবেদন নেই। তাই হিউম এগুলির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন। হিউমের মতে, জাগতিক বস্তু সম্পর্কে কোন জ্ঞান সুনিশ্চিত নয়। তাই হিমের মতবাদ দর্শনের ইতিহাসে সংশয়বাদ নামে পরিচিত।
সমালোচনা: জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে হিউমের মতবাদ সন্তোষজনক নয়। কেননা, তাঁর মতবাদে নিম্নলিখিত ত্রুটিগুলি বর্তমান।
১) হিউমের অভিজ্ঞতাবাদের চরম পরিণতি হল সংশয়বাদ। কিন্তু সংশয়বাদকে কোন মতেই সমর্থন করা যায় না।
২) হিউম কোন স্থায়ী মন ও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কিন্তু স্থায়ী মন বা আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার না করলে স্মৃতির ব্যাখ্যা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
৩) হিউম জ্ঞানের উৎপত্তির ক্ষেত্রে বুদ্ধির অবদানকে স্বীকার করেননি। কিন্তু সার্বিক ও অবশ্য জ্ঞান লাভ করার জন্য বুদ্ধির অবদানকে স্বীকার করতেই হয়।