প্রশ্ন: সাদৃশ্যমূলক যুক্তির মূল্যায়নের মানদণ্ডগুলি উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর।(Explain with examples the criteria used for evaluating analogical arguments. ).
উত্তর : সাদৃশ্যমূলক যুক্তির ভিত্তি হল সাদৃশ্য। কাজেই তার সিদ্ধান্ত শধুই সম্ভাবনামমূলক। সম্ভাব্যতা হল কম-বেশীর ব্যাপার। কাজেই সাদৃশ্যমূলক অননুমানের মূল্য বিচারের সময় দেখতে হবে যে, অনুমানটি যে সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করছে তার, সম্ভাব্যতার পরিমাণ কম বা বেশী। যেসব মানদণ্ড প্রয়োগ করে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সম্ভাব্যতার পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে সেগুলি হল --
(১) সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সম্ভাব্যতা বিচারের প্রথম মানদন্ড হল যতগুলি বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্যের কথা বলা হচ্ছে তাদের সংখ্যা নিরূপণ করা। ধরা যাক, আমি যে লন্ড্রীতে কাপড় কাচতে দিয়েছিলাম সেই লন্ড্রী কাপড় ভাল কাচেনি বলে আমাকে বলতে পারে যে, একবার কাপড় খারাপ কেঁচেছে বলে ওই লন্ড্রীকে বাতিল করে না দিয়ে আর একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। এর জবাবে আমি যদি দেখাতে পারি যে, শ্যাম, যদু, মধু রহিম, দীপক, হীরক এবং মানিকও ওই লন্ড্রীতে কাপড় কাচিয়েছিল এবং তাদের কাপড়ও খারাপ কেঁচেছে, তাহলে প্রথমে ওই লন্ড্রী সম্পর্কে আমি যে সিদ্ধান্ত করেছিলাম তার সম্ভাব্যতা অনেক বেশী পরিমাণে বৃদ্ধি পাবে। সুতরাং একটিমাত্র দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে সাদশামূলক যুক্তির সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা অপেক্ষা বেশীসংখ্যক দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনা বেশী।
(২) সাদশ্যমূলক যুক্তির মংল্যায়নের দ্বিতীয় মানদণ্ড হল—দুটি বস্তুর মধ্যে যতগুলি বিষয়ে সাদৃশ্য আছে তাদের সংখ্যার উপর সাদৃশ্যমলক যুক্তির সম্ভাব্যতার পরিমাণ নির্ভর করে। আমি যে দোকান থেকে এর আগে জুতো তৈরি করিয়েছিলাম এবং যা বেশ টেকসই হয়েছিল, এবারও সেই দোকান থেকেই জুতো তৈরি করিয়েছি, সুতরাং এবারের জুতো জোড়াও টেকসই হবে। এটি সাদৃশ্যমূলক যুক্তির উদাহরণ । কিন্তু এই সিদ্ধান্তটিরই সত্য হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী হবে যদি আশ্রয়বাক্যগুলি ঘোষণা করে যে, জুতো জোড়া শুধু যে একই দোকান থেকে তৈরি হয়েছে তা-ই নয়, যে লোকটি আগের জুতো জোড়া তৈরি করেছিল, সেই লোকই বর্তমান জুতো জোড়া তৈরি করেছে, আগের জুতো জোড়ার মতই এই জোড়াও বেশ দামী, দুয়েরই চামড়া একই মানের, সেলাইয়ের ব্যাপারেও একই ধরনের দক্ষতা দেখা গিয়েছে এবং আগের জুতো জোড়া আমি যেভাবে যত সময় পরেছি, এই জোড়াও সেইভাবে এবং সেই পরিমাণ সময় ব্যবহার করবো।
(৩) সাদৃশ্যমলেক মূল্যায়নের তৃতীয় নীতি হল— যেসব আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সেইসব আশ্রয়বাক্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্তের শক্তি বিচার করা। ধরা যাক, শ্যাম একটি "নতুন" কেরোসিন স্টোভ কিনেছে এবং এক লিটার কেরোসিন তেলে সেই স্টোভ সাত ঘণ্টা জ্বলে। রাম ওই একই “নতুন” স্টোভ কিনে কিছুটা সম্ভাব্যতার সাথে অননুমান করতে পারে যে, তার স্টোভটি যেহেতু শ্যামের স্টোভের মতই, অতএব তার স্টোভও এক লিটার তেলে সাত ঘণ্টা জলবে। কিন্তু একই আশ্রয়বাক্যের ভিত্তিতে রাম ভিন্ন রকম সিদ্ধান্তেও আসতে পারে। যেমন—রাম যদি সিদ্ধান্ত করে যে তার স্টোভ এক লিটার তেলে পাঁচ ঘণ্টার বেশী জলবে তবে সিদ্ধান্তের সম্ভাব্যতা হবে খুব বেশী। যদি সে সিদ্ধান্ত করে স্টোভটি এক লিটার তেলে ছয় ঘণ্টা জ্বলবে তবে সিদ্ধান্ত ততটা জোরালো হবে না। যদি রাম সিদ্ধান্ত করে যে তার স্টোভটিও শ্যামের স্টোভের মত এক লিটার তেলে ঠিক সাত ঘণ্টাই জলবে তাহলে তার সিদ্ধান্ত খুবই দুর্বল হবে।
(8) আশ্রয়বাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তগগুলির সাথে যে দৃষ্টান্তের সঙ্গে সিদ্ধান্তের সম্পর্ক আছে তার বৈসাদৃশ্যের সংখ্যা নিরূপণ করে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির মূল্যায়ণ করা যায়। ধরা যাক, শ্যাম যে “নতুন” স্টোভ কিনেছে তা এক লিটার কেরোসিন তেলে সাত ঘণ্টা জলে। রাম-ও "নতুন" স্টোভ কিনে সিদ্ধান্ত করলো যে, তার স্টোডও এক লিটার কেরোসিন তেলে সাত ঘণ্টা জ্বলবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনা খুবই কমে যাবে যদি দেখা যায় যে শ্যাম যেখানে তার স্টোভের ফিতে সামান্য তুলে স্টোড জালাতো সেখানে রাম ফিতেগুলো খুব বেশী করে তুলে স্টোড জালাচ্ছে। এখানে আশ্রয়বাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তের এবং সিদ্ধান্তের মধ্যে বৈসাদৃশ্য সাদৃশ্যমূলক যুক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছে এবং সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনাকেও কমিয়ে দিচ্ছে।
(৫) আশ্রয়বাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্তগুলি পরস্পরের যত অসদৃশ হবে, সাদশ্যমূলক যুক্তির সিদ্ধান্ত তত জোরালো হবে। আশ্রয়বাক্যে যেসব দৃষ্টান্তের উল্লেখ থাকে তাদের সাথে সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্তের বৈসাদৃশ্য কমাবার একটা উপায় হল, আশ্রয়বাক্যে এমন সব দৃষ্টান্ত পরস্পরের অসদৃশ্য, মানে যাদের মধ্যে মিল নেই। আশ্রয়বাক্যের দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে সাদৃশ্য যত কম হবে সিদ্ধান্তের দৃষ্টান্তের সঙ্গে তাদের সকলের অসদৃশ হবার সম্ভাবনা তত কমে যাবে।
রাম প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে বি-এ পাস করেছে, কাজেই সে এম-এ পরীক্ষাতেও কৃতিত্ব দেখাতে পারবে—এই সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনা খুব বেশী। কেননা আরও পনের জন ছাত্র ওই একই কলেজ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে অনার্সে প্রথম শ্রেণীতে পাস করে এম-এ পরীক্ষাতে কৃতিত্ব দেখিয়েছে। এই যুক্তি আরও জোরালো হবে যদি আমরা দেখাতে পারি যে, আশ্রয়বাক্যে যে পনের জন ছাত্রের উল্লেখ করা হয়েছে তাদের পারস্পরিক সাদৃশ্য খুবই কম। অর্থাৎ যদি আশ্রয়বাক্যে উল্লেখ করা থাকে যে, যে পনেরটি ছাত্র এম-এ পরীক্ষায় কৃতিত্ব দেখিয়েছে তাদের মধ্যে পরিবারগত, বিত্তগত, সম্প্রদায়গত, দেশগত ইত্যাদি নানা পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্য আছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই পঞ্চম নীতিটি প্রথম নিয়মের গুরুত্ব নির্দেশ করে। আমরা যত বেশী সংখ্যক দৃষ্টান্ত নেব, ততই দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে বৈসাদৃশ্যের সংখ্যা বেশী হবার ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।
(৬) আশ্রয়বাক্যে উল্লিখিত দৃষ্টান্ত বা দৃষ্টান্তগুলি সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে যত প্রাসঙ্গিক হবে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনা তত বেশী হবে। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক—রাম যে দোকান থেকে জুতো কিনেছিল এবং যা টেকসই হয়েছিল, শ্যামও সেই একই দোকান থেকে জুতো কিনে আশা করছে যে তার কেনা জুতোও টেকসই হবে। এই যুক্তি দুর্বল। কিন্তু শ্যাম যদি বলতে পারে যে রাম যে দোকান থেকে জুতো কিনেছে সেও সেই দোকান থেকে কিনেছে, রামের জুতো ও তার জুতো একই চামড়া দিয়ে তৈরি, একই নির্মাতার তৈরি এবং নির্মাণের ব্যাপারে দক্ষতার প্রকাশ উভয় ক্ষেত্রে একই রকম, তাহলে শ্যামের কেনা জুতোও টেকসই হবে— এই সিদ্ধান্তের সত্য হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এখানে যুক্তিটি বেশ জোরালো, কেননা আশ্রয়বাক্যে উল্লিখিত বিষয়গুলি সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু শ্যাম যদি সিদ্ধান্ত করে যে, রামের জুতোর মত তার জুতোও টেকসই হবে, কারণ রামের জুতোর মতই তার জুতোর রং, রামের জুতোর মতই তার জুতোও বেশ চকচকে, একই রকম কাগজের বাক্সে জুতোকে রাখা হয়েছে এবং একই লোক উভয় জোড়া জুতো বিক্রি করেছে, তাহলে তার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে খুবই দুর্বল হবে, কেননা সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার পক্ষে উল্লিখিত বিষয়গুলি অপ্রাসঙ্গিক।
প্রশ্ন হতে পারে—সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন কোন, সাদৃশ্য প্রাসঙ্গিক অথবা অপ্রাসঙ্গিক? কি দিয়ে প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা হবে? এর উত্তরে বলা যায় যে, প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারটি কার্যকারণ সম্পর্কের দিক থেকেই ব্যাখ্যা করতে হবে। সাদৃশ্যমূলক যুক্তির ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক সাদৃশ্য হল সেগুলি যেগুলি কার্যকারণ সম্পর্কে যুক্ত গুণ বা ঘটনা নিয়ে আলোচনা করে।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির মূল্যায়ন করতে গেলে কার্যকারণ সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। অভিজ্ঞতার সাহায্যে অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের সাহায্যে এই কার্যকারণ সম্পর্ক' আবিষ্কৃত হয়।
সাদৃশ্যমূলক যুক্তির ক্ষেত্রে আশ্রয়ে বাক্যে যে গুণের কথা বলা হয়েছে তার সাথে সিদ্ধান্তে উল্লিখিত গুন বা বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্ক থাকলে সাদৃশ্যমূলক যুক্তির সত্য হবার সম্ভাবনা খুব বেশি হবে এবং যুক্তিটিকে. সবল বলা হবে।