জ্ঞানের উৎস সম্পর্কে লাইবনিজের মতবাদ সবিচার আলোচনা কর।
উত্তর:
প্রাচীন বুদ্ধিবাদী দার্শনিকদের মধ্যে পারমিনাইডিস, সক্রেটিস এবং প্লেটোর নাম উল্লেখযোগ্য। আর আধুনিককালের উল্লেখযোগ্য বুদ্ধিবাদী দার্শনিক হলেন - ডেকার্ট, স্পিনোজা, লাইবনিজ প্রমূখ।
নিম্নে জ্ঞানের উৎপত্তি সম্পর্কে আধুনিক বুদ্ধিবাদী দার্শনিক লাইবনিজের মতবাদ আলোচনা করা হলো -
লাইবনিজ-এর মতবাদ: দেকার্তের পরবর্তী এবং স্পিনোজার সমসাময়িক জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ বুদ্ধিবাদী হওয়া সত্ত্বেও দেকার্ত ও স্পিনোজা থেকে কিছুটা ভিন্নমত পোষণ করেন। দেকার্ত ও স্পিনোজার মতে আমাদের কোন কোন ধারনা সহজাত। কিন্তু লাইবনিজ বলেন, 'আমাদের সকল ধারনাই সহজাত বা অন্তর ধারনা'। উল্লেখ্য, এখানে সহজাত বলতে লাইবনিজ বুঝিয়েছেন -- আমাদের মনের মধ্যেই সমস্ত জ্ঞানের সম্ভাবনা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। একখণ্ড প্রস্তরের মধ্যে যেমন মর্মর মূর্তি সুপ্ত অবস্থায় থাকে, মানুষের মনের সমস্ত ধারণা ঠিক তেমনি ভাবে মনের মধ্যে সুপ্ত থাকে। মনের ক্রিয়ার মাধ্যমেই সেগুলি ব্যক্ত হয়। আমাদের এই জড়জগৎ মনের সহজাত ধারণার মূর্ত প্রকাশ মাত্র।
লাইবনিজ দুই প্রকার জ্ঞানের কথা বলেছেন- জাগতিক বিষয় সংক্রান্ত সত্য এবং বুদ্ধি লব্ধ সত্য। তাঁর মতে জাগতিক বিষয় সংক্রান্ত সত্য হলো অভিজ্ঞতালব্ধ এবং সেই কারণে তার সার্বিক ও স্বতঃসিদ্ধরূপে গণ্য নয়। কিন্তু বুদ্ধি লব্ধ সত্যটি অবশ্যই বুদ্ধি লব্ধ এবং সেই কারণেই তা সার্বিক ও স্বতঃসিদ্ধরূপে গণ্য। সুতরাং, কেবলমাত্র বুদ্ধি বা প্রজ্ঞার দ্বারাই নিয়ত, সার্বিক, শাশ্বত জ্ঞানের সন্ধান পাওয়া যায়। তবে লাইবনিজ মনে করেন ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধিজাত জ্ঞান -- এদুটি বিজাতীয় জ্ঞান নয়। পার্থক্য এই যে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান বুদ্ধি দ্বারা প্রাপ্ত জ্ঞান অপেক্ষা অস্পষ্ট ও কম প্রামাণ্য যুক্ত হয়। ইন্দ্রিয় বুদ্ধিরই এক অনুন্নত রূপ মাত্র। কিন্তু ইন্দ্রিয় কখনোই সার্বিক ও আবশ্যিক জ্ঞান যোগাতে পারে না। লাইবনিজ এ প্রসঙ্গে লকের জ্ঞানতত্ত্বকে খন্ডন করে যথার্থই বলেছেন - "বুদ্ধিতে এমন কিছু নেই যা, পূর্বে ইন্ডিয়ার মধ্যে ছিল না, কেবলমাত্র বুদ্ধি ছাড়া"।
লাইবনিজের মতে, এই বিশ্ব জগত হলো অসংখ্য চিৎপরমাণু বা চিদনুর সমন্বয়। সেখানে জড় বলে বাস্তবিক কিছুই নেই। প্রতিটি চিৎপরমাণু বা মনাড চেতন গুণসম্পন্ন এক একটি আত্মা এবং এই আত্মা বা মনাড সংখ্যায় অসংখ্য বা বহু। লাইবনিজ বলেন, মনাড বা চিৎপরমাণু হলো আধ্যাত্মিক দ্রব্য, যেখানে চেতনা সুপ্ত অবস্থায় নিহিত থাকে। আধ্যাত্বিক দ্রব্য হিসেবে প্রতিটি মনাড সমগ্র বিশ্বজগতকে প্রতিবিম্বিত করে। প্রতিটি মনাড এক একটি জীবন্ত দর্পণ এবং নিজে নিজে ক্রিয়াশীল। প্রতিটি মনাড স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় তা গবাক্ষহীন এবং নিশ্চিদ্র হওয়ায় কোন কিছু যেমন মনাড থেকে নির্গত হতে পারে না, তেমনি বাইরে থেকে কোন কিছু মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনা। কাজেই, সমস্ত ধারণা অন্তর বা সহজাত, বহিরাগত ধারণা বলে কিছু নেই। এইরূপ মত পোষণ করার জন্য লাইবনিজকে অনেকে চরমপন্থী বুদ্ধিবাদী বলে থাকেন। তবে লাইবনিজকে নরমপন্থী বুদ্ধিবাদী বলাই সঙ্গত।
সমালোচনা:
১) লাইবনিজ যে চিৎপরমাণুর উল্লেখ করেছেন তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কেননা, চিৎপরমাণু প্রত্যক্ষ গ্রাহ্য নয়।
২) লাইবনিজের মতে, জড় বা জড়জগৎ বলে কিছু নেই। জড়জগতের প্রত্যক্ষ ভ্রমাত্মক। কিন্তু নিশ্চেতন জগতের অস্তিত্বকে এই ভাবে অস্বীকার করা যায় না।
৩) লাইবনিজ আত্মা বা মনাডকে বহু বলেছেন কিন্তু বহুর মধ্যে কোন ঐক্য বিধায়ক শক্তির উল্লেখ করতে পারেননি। ফলে তাঁর মতবাদ চরম বহুত্ববাদে পর্যবসিত হয়েছে।
1 comments:
God blessb u sir,ur note is excellent
Thank u sir
Post a Comment