প্রশ্ন: সাংখ্য দর্শনে পুরুষের স্বরূপ কি? পুরুষের অস্তিত্বের স্বপক্ষে যুক্তি গুলি কি কি? পুরুষ এক না বহু? আলোচনা কর। ২০ নম্বর
উঃ
পুরুষ: প্রকৃতি তত্ত্ব ছাড়াও সাংখ্যদর্শনের দ্বিতীয় একটি তত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে সেটি হলো পুরুষ বা আত্মা। পুরুষ হলো সাংখ্যের দ্বিতীয় স্বীকৃত তত্ত্ব। আমরা পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারি না। জগতের সবকিছুকে অস্বীকার করলেও আমার নিজের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা অসম্ভব। আত্মার অস্তিত্ব স্ব-প্রকাশ, তাই সাংখ্য দার্শনিকগণ আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। এই পুরুষ বা আত্মা সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণের অতীত এবং তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মের আরেকটি শ্রেণীর দ্রব্য। পুরুষকে বর্জন করে জগতের ব্যাখ্যা হতে পারে না।
সাংখ্য দার্শনিকদের মতে, পুরুষ বা আত্মা দেহ নয়, মন নয়, বুদ্ধি নয়, ইন্দ্রিয়ও নয়। আত্মা এদের থেকে স্বতন্ত্র। পুরুষ হচ্ছে এক সচেতন সত্তা যা সব সময় জ্ঞাতা কিন্তু কখনোই জ্ঞেয় বা জ্ঞানের বিষয় নয়। পুরুষ নির্বিকার জ্ঞান স্বরূপ। আত্মা শুদ্ধ চৈতন্য স্বরূপ, তাই পুরুষ বা আত্মার কোন পরিবর্তন বা বিকার হয়না। পুরুষ সনাতন - তার উৎপত্তি বা ধ্বংস নেই। পুরুষ পরিচ্ছিন্ন বা সীমিত নয়। পুরুষ বিভু বা সর্বব্যাপী। পুরুষ লোভ, মোহ, রাগ-বিরাগ মুক্ত। পুরুষ অপরিণামী।
পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ: সাংখ্য দর্শনে পুরুষ বা আত্মার অস্তিত্বের স্বপক্ষে একাধিক যুক্তি দেখানো হয়েছে ও এইসব যুক্তি দ্বারা পুরুষ বা আত্মার আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তিগুলি এইরকম -
ক) সংঘাতপরার্থত্বাৎ: সংঘাত অর্থাৎ যৌগিক পদার্থ অপরের উদ্দেশ্য পূরণ করে থাকে। এইসব যৌগিক পদার্থের নিজস্ব কোন উদ্দেশ্য নেই। টেবিল চেয়ার ঘট পট প্রভৃতি সংঘাত দ্রব্য পর-প্রয়োজনে নিবেদিত। এইসব সংঘাত দ্রব্যগুলি কোন চেতন সত্তার প্রয়োজন মেটায়। এই চেতন সত্তাই পুরুষ।
খ) ত্রিগুণাদি বিপর্যয়াৎ: সব জ্ঞেয় বস্তুই ত্রিগুণাত্মিকা অর্থাৎ সব জ্ঞেয় বস্তুরই সত্ত্ব রজঃ ও তমঃ এই তিনটি গুণ আছে। কাজেই এদের দ্রষ্টা হিসেবে এমন একটি সত্তার অস্তিত্ব থাকতে হবে যার মধ্যে শুধু চৈতন্য আছে, কিন্তু গুণত্রয় নেই। এই সত্তাই হলো পুরুষ।
গ) অধিষ্ঠানাৎ: যার অধিষ্ঠানের জন্য দেহ বুদ্ধি-অহংকার-মন বিশিষ্ট হয়ে চেতন পদার্থের মত মনে হয় এবং যার অভাবে দেহ বুদ্ধি- অহংকার-মনবিহীন হয়ে অচেতন হয়ে পড়ে তাই পুরুষ বা আত্মা। সচেতন একজন রথী না থাকলে যেমন অচেতন রথ ঠিক পথে চলতে পারে না, তেমনি অচেতন প্রকৃতির কার্য যে নিয়ম শৃঙ্খলার সাথে ঘটতে দেখা যায় তাও কোন সচেতন সত্তার সাহায্য ছাড়া হতে পারে না। এই সচেতন সত্তাই পুরুষ।
ঘ) ভক্তৃভাবাৎ: সুখ-দুঃখ ও বিষাদাত্মক ভোগ্যবস্তুর ভোক্তা রূপে চেতন পুরুষের অস্তিত্ব মানতে হবে। ভোগ্যবস্তুর অস্তিত্ব মেনে নিলে ভোক্তার অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে হয়। সুখ, দুঃখ ও বিষাদ ইত্যাদি ভোগ্য। কোন জড় ও অচেতন দ্রব্যের পক্ষে ভোগ করা সম্ভব নয়। তাই ভোক্তা রূপে চেতন সত্তার অস্তিত্ব মানতেই হবে এবং চেতন সত্তাই পুরুষ।
ঙ) কৈবল্যার্থং প্রবৃত্তেশ্চ: অনেকের মধ্যে কৈবল্য বা মুক্তির চেষ্টা দেখা যায়। প্রকৃতি কিংবা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত বস্তু তো অচেতন এবং স্বভাবতই দুঃখযুক্ত। কাজেই তাদের পক্ষে দুঃখ থেকে মুক্তির প্রশ্ন ওঠেনা। তাহলে প্রকৃতি থেকে স্বতন্ত্র এক সচেতন সত্তার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়, নইলে কৈবল্য লাভের চেষ্টার কোনো অর্থ হয় না। এই সচেতন সত্তাই পুরুষ।
বহু পুরুষবাদ বা আত্মার বহুত্ববাদ : সাংখ্য মতে, পুরুষ বা আত্মাএক নয়, বহ। সাংখ্য কার নিম্নলিখিত যুক্তির সাহায্যে পুরুষের বহুত্ব প্রমাণ করেছেন:
(ক) বিভিন্ন জীবের মধ্যে জন্ম, মৃত্যু, ইন্দ্রিয় বিষয়ে পার্থক্য দেখা যায়। এক ব্যক্তির জন্ম হলে অন্য ব্যক্তির জন্ম হয় না। একজন অন্ধ বা বধির হলে অন্যজন অন্ধ বা বধির হয়না। এরকম যখন বাস্তবে হয় না তখন আমাদের মানতেই হবে আত্মা এক নয়, বহু।
(খ) সমস্ত জীবের মধ্যে এক আত্মা থাকলে সমস্ত জীবের প্রবৃত্তি যুগবৎ হত অর্থাৎ একজনের প্রবৃত্তিতে অন্যজনেরও একই প্রবৃত্তি জাগ্রত হত। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা হয়না। যেমন- একজন যখন যাচ্ছে, আর একজন তখন আসছে। সুতরাং জীবের প্রবৃত্তিগত ভিন্নতাই আত্মার ভিন্নতা প্রমাণ করে। তাই এক নয়, বহু।
(গ) একথা আমরা স্বীকার করি যে মানুষ দেবতা নয়, আবার পশুও নয়। একই আত্মা যদি সকলের মধ্যে থাকতো তবে দেবতা মানুষ ও পশুপাখির কোন প্রভেদ থাকত না। কাজেই, আত্মার বহুত্ব স্বীকার করতে হবে।
(ঘ) মৃত্যুর পর পূণ্যাত্মার স্বর্গবাস, পাপাত্মার নরকবাস। এর দ্বারাও প্রতিপন্ন হয় যে বিভিন্ন জীবের মধ্যে বিভিন্ন আত্মা বিরাজমান। সমস্ত জীবের মধ্যে এক আত্মা থাকলে একজনের মুক্তিতে অন্য সবাই মুক্তি লাভ করতো। সুতরাং আত্মা এক নয়, বহু।
<<<<<>>>>>