প্রশ্ন: শিক্ষা চিন্তায় রবীন্দ্রনাথের অবদান মূল্যায়ন কর।
উঃ
উঃ
ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ মূলত কবি। কিন্তু মানব জীবনের এমন কোন অভিজ্ঞতা নেই, যাকে তাঁর চিন্তার ছোঁয়া স্পর্শ করতে পারেনি। পাশ্চাত্য সভ্যতার, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সার্থক সমন্বয় ঘটেছিল ঠাকুর পরিবারে। এই প্রভাব শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের উপর পড়েছিল। তাছাড়া শৈশবকালে বিদ্যালয় সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং তার পারিবারিক প্রভাবে গঠিত জীবন দর্শন, পরবর্তীকালে তাঁর শিক্ষা চিন্তা কে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ: রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয় উপনিষদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন সমস্ত সৃষ্টির মূলে আছে সর্বব্যাপী আধ্যাত্মিক শক্তি। এই শক্তি বিশ্বজগতে সতত প্রকাশমান। একে তিনি বলেন বিশ্বচেতনা। রবীন্দ্রনাথের জীবনাদর্শের মূল কথা হলো বিশ্ব বৈচিত্রের মধ্যে এক আধ্যাত্মিক শক্তি বিরাজমান। বহু বৈচিত্রের মাঝে এই শক্তির ঐক্যের যে নিয়ম, সেই নিয়মকে জেনে, আনন্দরূপে তাকে লাভ করাই মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও সাধনা। রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শ তাঁর এই দার্শনিক বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত। শিক্ষার আদর্শগত দিক নির্ধারণের জন্য তিনি ভাববাদী দর্শনের উপর নির্ভর করেছেন। তিনি বলেছেন, 'তাকেই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা বলি, যা কেবল তথ্য পরিবেশন করে না, * তিনি শিক্ষাকে বাস্তবায়িত করার কথা চিন্তা করে বিশেষধর্মী কতগুলি উদ্দেশ্য বেছে নিয়েছিলেন। তাই তিনি বলেছেন, শিক্ষার বিশেষ ধর্মী উদ্দেশ্য হবে -
১) শিক্ষার্থীর জীবন বিকাশে সহায়তা করা।
২) শিক্ষার্থীর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি জাগিয়ে তুলতে সহায়তা করা, যার সাহায্যে শিক্ষার্থী বিশ্বের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা করবে।
৩) শিক্ষার্থীর মনে ধর্মীয় মনোভাব জাগ্রত করা।
৪) শিক্ষার্থীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক গুণ বিকাশে সহায়তা করা।
রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন ব্যক্তিজীবনে পূর্বোক্ত উদ্দেশ্যগুলি চরিতার্থ হলে তবেই শিক্ষার প্রকৃত লক্ষে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, এই উদ্দেশ্যগুলি চরিতার্থ করার মাধ্যমে জীবনাদর্শ গড়ে ওঠে।
পাঠ্যক্রম: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষাদর্শের উপর ভিত্তি করে পাঠক্রম সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা শুরু। তিনি পাঠক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সামনে সংস্কৃতির পূর্ণরূপ তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তিনি বিদ্যালয়কে মানব সংস্কৃতির অনুশীলনের ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। এইজন্য তিনি তার প্রস্তাবিত পাঠ্যক্রমের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, নৃত্য, পল্লী উন্নয়ন মূলক কাজ এবং অন্যান্য সামাজিক কর্মসূচিকে অন্তর্ভুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে তাঁর মতামত ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মাতৃভাষা শিক্ষার উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বিজ্ঞান আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি, একথা স্বীকার করেও রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষের আত্মিক শক্তির বিকাশ করতে হলে বিজ্ঞানের সঙ্গে দার্শনিক আদর্শের সমন্বয় ঘটানো প্রয়োজন।
শিক্ষণ পদ্ধতি: রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক শিক্ষা পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন শিক্ষণ পদ্ধতি পরিস্থিতিভেদে বিভিন্ন রকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে শিক্ষণ সম্বন্ধে তিনি তিনটি নীতি অনুসরণ করার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।
প্রথমত, শিক্ষণ হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন পরিবেশে। অর্থাৎ যে কোনো শিক্ষণ পদ্ধতি গ্রহণ করা হোক না কেন, তাতে যেন শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ থাকে। তিনি স্বাধীনতা বলতে স্বেচ্ছাচারকে মেনে নেন নি। তাঁর কাছে স্বাধীনতার অর্থ আত্মকর্তৃত্ব। পূর্ণ স্বাধীনতার মধ্যে শিক্ষার্থী নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার অধিকার অর্জন করলেই তার শিক্ষা সার্থক হবে।
দ্বিতীয়ত, আত্মকর্তৃত্বের প্রধান লক্ষণ হলো সৃজন। স্বাধীন মনোভাব থেকে সৃজন প্রতিভার বিকাশ হয়। অভিনয়, সংগীত ও হাতের কাজের উপর তাই তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন।
তৃতীয়ত, প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে তিনি শিক্ষাদানের কথা বলেছেন। মানুষের জন্ম বিশ্ব প্রকৃতি ও মানব সমাজের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ এই দুই উপাদানকে শিক্ষাদানের অপরিহার্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন।
শিক্ষক: রবীন্দ্রনাথ শিক্ষা চিন্তায় শিক্ষকের ব্যক্তিত্বের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিক্ষক সম্পূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তিনি বলেছেন শিক্ষকের সেবামূলক মনোভাব থাকা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার্থীর সঙ্গে শিক্ষকের সম্পর্কও আদর্শস্থানীয় দরকার। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছাড়া শিক্ষার কাজ চলতে পারে না। তাই শিক্ষককে শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর কর্তব্য পালনের পরামর্শ দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
মন্তব্য: রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা সম্পর্কিত ধারণাগুলিকে শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাই নীতিগুলি কে প্রয়োগ করার জন্য ১৯০১ সালে শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম স্থাপন করেন। প্রাচীন ভারতীয় কৃষ্টির প্রতি আস্থা এবং নিজস্ব চিন্তার ফসল এই বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি বলেছেন - "আমার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, এখানকার এই প্রভাতের আলো, শ্যামল প্রান্তর যেন শিশুদের চিত্ত স্পর্শ করতে পারে।" বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তায় প্রাচীন ও নবীন, ব্যক্তি ও সমাজ, তত্ব ও কর্ম সবকিছুর মধ্যে এক সার্থক সমন্বয় ঘটেছিল।
Translation
Translation
Question: Evaluate Rabindranath's contribution to education thought.
Introduction: Rabindranath is originally a poet. But there is no experience of human life that could not be touched by his thoughts. Western civilization, scientific perspectives and Indian spiritualism were the perfect combination of the Thakur family. This influence came on Rabindranath in his childhood. Moreover, his personal experiences about school during childhood and his family-influenced life philosophy, especially his later education, influenced him.
Rabindranath's teachings: Rabindranath was influenced by the ideals of the ancient Indian colonies. He believed that at the root of all creation is the universal spiritual power. This power is ever-present in the world. He called it world-consciousness. The essence of Rabindranath's vision is that there is a spiritual power inherent in world diversity. Knowing the rules of the unity of this energy among many variations, the goal and pursuit of human life is to achieve it individually. Rabindranath's teachings were influenced by his philosophical beliefs. He relied on the prophet's philosophy to determine the normative aspects of education. He says, 'I call him the best education, which does not only serve information, * he has chosen a number of motives, especially as he thinks of implementing education. So he says education will have a special religious purpose -
1) To help develop the student's life.
2) To help the student to awaken the scientific viewpoint with which the student will try to unravel the mystery of the world.
3) To raise religious attitude in the mind of the student.
4) To help the student develop various social qualities.
Rabindranath believed that it was possible to achieve the true goals of education only if the aforementioned objectives were attainable in the individual's life. He believed that by attaining these motives, life-forms developed.
Curriculum: Rabindranath started thinking about the syllabus based on his teachings. He wanted to highlight the culture in front of the students through the curriculum. He regarded the school as a field of practice in human culture. For this reason he wanted to include language, literature, philosophy, science, art, music, dance, rural development work and other social programs in his proposed curriculum. His views on language education were significant. He placed the most emphasis on mother tongue education. Although Rabindranath acknowledged that science is the foundation of modern civilization, philosophical ideals need to be aligned with science in order to develop human spiritual power.
Teaching Methods: Rabindranath criticizes traditional teaching methods. He believed that teaching methods should be varied depending on the situation. However, he specifically mentioned three principles for teaching.
First, teaching will take place in a completely independent environment. That is, whatever teaching method is adopted, the students have the opportunity to work independently. He did not accept freedom of speech. To him freedom means self-esteem. Only if the student gains the right to control his or her mind in complete independence will his education be worthwhile.
Second, creation is one of the main signs of self-realization. From an independent attitude, the talent of creation is developed. He emphasized on acting, music and hand work.
Thirdly, he speaks of teaching by maintaining contact with the natural and social environment. Humans are born into the world of nature and human society. Rabindranath considered these two elements as essential components of education.
Teacher: Rabindranath has placed special emphasis on the personality of the teacher in the thinking of education. He believed that teachers were an essential part of the entire education system. He says it is important to have a teacher's service attitude. The teacher's relationship with the student is also exemplary. Rabindranath believed that education could not continue without mutual respect. Therefore, Rabindranath advised the teacher to perform his duties with respect and devotion.
Comment: Rabindranath did not confine his ideas of education to theoretical discussions. Therefore, in order to apply the principles, he set up a Brahmacharyasam at Santiniketan in 1901. Trusting in ancient Indian agriculture and cultivating its own thoughts, this school is. Explaining the purpose of the school, he said - "I only wished that the light of this dawn, the shimmering area, could touch the hearts of children." The thought of Rabindranath's teachings in the Vishvabharati was a perfect combination of all things, old and new, person and society, principle and action.
<<<<<<<<>>>>>>>
0 comments:
Post a Comment