প্রশ্ন: শিক্ষা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ কী? এর সংকীর্ণ ও ব্যাপক অর্থ আলোচনা কর।
উত্তর:
'শিক্ষা’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: “শিক্ষা” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “শাস” ধাতু থেকে যার অর্থ ‘শাসন করা', 'শৃঙ্খলিত করা’, ‘নিয়ন্ত্রিত করা', 'নির্দেশনা দেওয়া' ইত্যাদি। এখানে অর্থ হল ‘ প্রচলিত শিক্ষাদান পদ্ধতি। বাংলা ভাষায় 'শিক্ষা’ শব্দের সমার্থক হিসেবে বিদ্যা’ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়। 'বিদ্যা’ কথাটি সংস্কৃত ‘বিদ্’ ধাতু থেকে এসেছে। ‘বিদ্’ কথাটির অর্থ হল 'জ্ঞান অর্জন করা' বা 'জানা'। এক্ষেত্রে ‘বিদ্যা'- র অর্থ হয়েছে 'কোনাে কিছু সম্পর্কে জ্ঞান বা কৌশল আয়ত্ত করা'।
'এডুকেশন’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: 'Education' শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ভাষাতত্ত্ববিদরা ভিন্ন ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। এইসব মতামতকে চারটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা যায়।
(1) প্রথম মত: ‘শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ' 'Education' শব্দটি লাতিন শব্দ Educatio থেকে গৃহীত হয়েছে। 'Educatio' কথাটির উৎপত্তি ঘটেছে দুটি শব্দের সংমিশ্রণে। শব্দ দুটি হল ‘e' এবং 'duco'। 'e'- এর অর্থ হল ‘থেকে’ (from বা out of) এবং ‘duco'-র অর্থ হল অন্তর্নিহিত কোনাে কিছুকে প্রকাশ করা (to draw out)। এই মত অনুসরণ করে বলা যায়, 'education' বা 'শিক্ষা’-র অর্থ হল শিশুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনাগুলিকে প্রকাশিত হতে সাহায্য করা।
(2) দ্বিতীয় মত: 'Education' শব্দটির উৎপত্তি ঘটেছে লাতিন শব্দ 'Educare' থেকে। "Educare ” শব্দের অর্থ হল লালনপালন করা (to bring up), পরিচর্যা করা (to nourish), উদ্দীপিত করা বা জাগিয়ে তােলা (to raise) ইত্যাদি। সুতরাং এই মত অনুযায়ী, শিক্ষা হল শিশুকে বা অপরিণত শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত লালনপালন বা পরিচর্যা দ্বারা জীবনধারণের জন্য উপযােগী দক্ষতা ও কৌশল অর্জনে সাহায্য করা। শিশুর মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা থাকে, তাকে সুপ্তাবস্থা থেকে জাগিয়ে তােলা এবং জীবনপথে পরিচালিত করার প্রক্রিয়াই হল শিক্ষা।
(3) তৃতীয় মত: 'Education' শব্দটির উদ্ভব ঘটেছে লাতিন শব্দ 'Educere' থেকে। 'Educere' শব্দের অর্থ হল নির্দেশ দান করা (to lead out), প্রকাশ করা(to drawout) ইত্যাদি। শিক্ষাবিদদের এই মত অনুযায়ী, শিক্ষা হল নির্দেশ দানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সুপ্ত গুণাবলিকে প্রকাশ করে শিক্ষার্থীকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।
(4) চতুর্থ মত: 'Education' কথাটি এসেছে লাতিন শব্দ 'Educatum' থেকে। 'Educatum' শব্দটির অর্থ হল শিক্ষাদানের কাজ (teaching)। এই অর্থে শিক্ষা বলতে বােঝায়, শিক্ষাদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে বিকশিত করা। Education- এর ব্যুৎপত্তিগত চার ধরনের মতবাদকে সংক্ষিপ্ত আকারে সাজালে, Education বা 'শিক্ষা’ বলতে যা বােঝায়, তা হল
• শিক্ষার্থীদের মধ্যেকার সম্ভাবনাগুলির বিকাশ ঘটিয়ে, তাদের যথাযথ প্রকাশে সহায়তা করা।
• শিক্ষার্থীর উপযুক্ত প্রতিপালনের দ্বারা তার মধ্যেকার সুপ্ত সম্ভাবনাগুলিকে জাগ্রত করা ও পরিচর্যার দ্বারা তাকে জীবনপথে অগ্রসর হতে সাহায্য করা।
• শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে, তাকে যথােপযুক্ত নির্দেশ দান করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করা।
• উপযুক্ত শিক্ষা দানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে বিশেষ বিষয়ে শিক্ষিত করে তোলা।
সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা: সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা বলতে, যে কোনাে প্রকার জ্ঞান অর্জন, তথ্য সংগ্রহ বা কৌশল আয়ত্ত করাকে বােঝায়। এক কথায় শিক্ষা হল স্কুল, কলেজ প্রভৃতি বিদ্যায়তন নির্ধারিত কোনাে পাঠক্রম অনুসরণ করে কোনাে পর্ষদ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি, ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট হস্তগত করা। অর্থাৎ প্রথাগত শিক্ষা এখনও অর্থাগমের জগতে যাওয়ার ছাড়পত্র, Bread and Butter নীতি। সুতরাং, সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা হচ্ছে এক প্রকার পারদর্শিতা অর্জন।
আমাদের বর্তমান সভ্য সমাজে শিক্ষিত-অশিক্ষিতের ব্যবধান না ভেদাভেদ এই সংকীর্ণ ধারাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। অর্থাৎ যারা কোনাে পর্যদ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি, ডিপ্লোমা বা সাটিফিকেট পেয়েছে তারাই শিক্ষিত আর যারা তা অর্জন করেনি তারা অশিক্ষিত। আর সাধারণ মানুষ সংকীর্ণ অর্থেই, “শিক্ষা" কথাটি ব্যবহার করে থাকে। অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিরও শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা যথেষ্ট উদার নয়।
শিক্ষা মতবাদগুলির মধ্যে আহরণ তত্ত্ব (education by accretion) সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য, যা সংকীর্ণ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। এই মতবাদ অনুসারে শিক্ষা জ্ঞান বা তথ্য আহরণের পদ্ধতিমাত্র। অর্থাৎ শিশুমনের শুন্যভাণ্ডার নানাবিষয়ক জ্ঞান দ্বারা পরিপূর্ণ করাই শিক্ষার কাজ। তাই শিক্ষা হল জ্ঞানার্জনের নামান্তর। যেমন— জলাধার থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে গৃহস্থের ঘরে জল পৌঁছে যায়, তেমনি জ্ঞান, জ্ঞানভাণ্ডার (বই অথবা শিক্ষক) থেকে নির্দিষ্ট পথে শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে যাবে। এই তত্ত্বটিকে Pipe - line Theory বলা হয়। অর্থাৎ সংকীর্ণ মতানুযায়ী শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল পুঁথিগত তথ্য আহরণের উপর আরােপ করা হয়েছে।
সংকীর্ণ অর্থে "শিক্ষা” অর্থটি বিশ্লেষণ করলে আমরা কতকগুলি ত্রুটি লক্ষ করি তা নিচে আলােচনা করা হল :
(১) সংকীর্ণ অর্থে শিক্ষা কেবল পুঁথিগত তথ্য আহরণের উপর গুরুত্ব আরােপ করার ফলে দৈহিক বিকাশের দিকটি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়েছে।
(২) মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়শক্তির বিকাশ, স্বাধীন চিন্তা, সৃজনশীলতা, রুচিবােধ, সৌন্দর্যানুভূতির উন্মেষ, সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বিধানের যােগ্যতা প্রভৃতি বিষয়ে একেবারে অবহেলিত হয়েছে।
(৩) সংকীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর ব্যক্তিসত্তা, তার স্বতঃস্ফূর্ত কাজ, আশা - আকাঙ্ক্ষা, প্রবৃত্তি, প্রক্ষোভ, অনুরাগ প্রভৃতির প্রতি দৃষ্টি দেওয়া হয় না।
(৪) সংকীর্ণ ধারণা অনুযায়ী বিশেষ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রেখে শিক্ষক শিশুদের উপর যে জ্ঞানের বােঝা অর্পণ করতেন তাই হল শিক্ষা। এই ধারণা অনুযায়ী শিক্ষার উৎস হচ্ছে শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তক ইত্যাদি। ফলে ঐ তথ্য থেকে শিক্ষার্থী কোনাে কিছু গড়তে পারে না। অতিরিক্ত চাপে স্মৃতিশক্তি ভারাক্রান্ত হয়।
(৫) সংকীর্ণ শিক্ষামতবাদ বিদ্যালয় ও সমাজের মধ্যে, জীবন ও শিক্ষার মধ্যে এক বিশদ ব্যবধান সৃষ্টি করেছে। সুতরাং, সংকীর্ণ ধারণা অনুযায়ী জ্ঞানকে অপরিবর্তনীয়, সুসম্পূর্ণ, সুনির্দিষ্ট বিষয়রূপে গণ্য করা হয়। এই অর্থে শিক্ষা হল প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের থেকে অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীর মধ্যে জ্ঞান সঞ্চালিত হবার প্রক্রিয়া।
ব্যাপক অর্থে শিক্ষা: শিক্ষার উল্লিখিত সংকীর্ণ অর্থ ছাড়া আর একটি ব্যাপক অর্থ আছে । এই ব্যাপক অর্থে শিক্ষা হল জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া । জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কোন ব্যক্তি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, তাই হল শিক্ষা। তাই শিক্ষার ব্যাপক অর্থ হল শিশুর জৈব, মানসিক, সামাজিক সর্বপ্রকার বা সর্বাঙ্গীণ জীবন বিকাশ। এই বিকাশ ঘটে নানাবিধ অভিযােজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। অর্থাৎ ব্যাপক অর্থে শিক্ষা, জ্ঞানসংগ্রহের কৌশল নয়, বৃহত্তর জীবন বিকাশের প্রক্রিয়া।
শিক্ষাকে যদি সমগ্র জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া হিসাবে ধরা হয়, তাহলে তার একটি অন্যতম কাজই হল মানুষকে পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে সাহায্য করা। শিক্ষা মানুষকে সেই সম্প্রতি বিধানে সাহায্য করে, তাকে সুষ্ঠু জীবনযাপনে সাহায্য করে। শিক্ষার সাহায্যেই শিশু পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিবিধানের জন্য কতকগুলি কৌশল বা দক্ষতা অর্জন করে। আবার এই যে কৌশল বা দক্ষতা শিশু অর্জন করছে পরিবেশের সতে সঙ্গতিবিধানের জন্য তা আত্মসক্রিয়তার মাধ্যমেই করছে। কারণ, পরিবেশের সঙ্গে সার্থক সামঞ্জস্য স্থাপন আত্মবিকাশের অপরিহার্য অঙ্গ। শিক্ষা ব্যতীত মানবজীবনে সামঞ্জস্য বিধান অসম্ভব এবং ইহার অভাবে আত্মবিকাশলাভ এমনকি জীবনধারাও সম্ভব নয়। তাই “ শিক্ষাই জীবন, জীবনই শিক্ষা ” (ডিউই)। তাই ব্যাপক অর্থে আত্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধান ও পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের নামই শিক্ষা। আর এই আত্মসক্রিয়তা হচ্ছে একটি অন্তর্নিহিত প্রেরণা যা শিশুকে বিভিন্ন ধরনের কাজে উদ্দীপিত করে। সুতরাং, শিশুকে যদি আত্মসক্রিয় করে না তােলা যায়, তাহলে শিক্ষার সমস্ত আয়ােজন ব্যর্থ হতে বাধ্য।
শিশুর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনার বা ক্ষমতার বিকাশ সাধনই হল প্রকৃত শিক্ষা। অর্থাৎ সে সহজাত অপরিসীম শক্তিসম্ভাবনা নিয়ে সমাজ পরিবেশের মধ্যে জন্মগ্রহণ করে এবং সেই শিশু জন্মগত প্রবণতা ও কতকগুলি সম্ভাবনা নিয়ে বিদ্যালয়ে আসে। সেইসব সম্ভাবনাকে যথাযথ পথে বিকশিত করাই হল শিক্ষা, কারণ তাদের এই শক্তিসম্ভাবনা পরিবেশের সংস্পর্শে এসে ঐ পরিবেশেরই বিভিন্ন পথকে আশ্রয় করে আত্মপ্রকাশ করে এবং নানা পরিবর্তন, পরিমার্জনা ও সংযােগের মধ্যে দিয়ে বিকাশ লাভ করতে থাকে আত্মশক্তি ও জীবন পরিবেশের ঘাত - প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা লাভ করে, পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সংযােজন হয়, অভিজ্ঞতার পুনর্বিন্যাস বা পুনর্গঠন হয়ে থাকে। এই নতুন নতুন অভিজ্ঞতালাভ ও অভিজ্ঞতার পুনর্গঠনকে, সহজাত শক্তি সম্ভাবনার পরিবর্তন, পরিমার্জন ও উৎকর্ষকে, পরিবেশের মাধ্যমে ব্যক্তির পরিপূর্ণ আত্মবিকাশকেই আমরা শিক্ষা বলি। শিক্ষার এইরূপ ব্যাপক অর্থ গ্রহণ করলে দেখা যায় যে কেবল বিদ্যালয়েই শিক্ষালাভ হয় না। বৃহত্তর জগতের প্রতিটি পরিস্থিতিতেই মানুষকে শিক্ষাদান করে থাকে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষার এই আলােচনা মনােবিদ্যা ও সমাজবিদ্যার বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাই ব্যাপক অর্থে—
• শিক্ষা হল শিশুর জৈব, মানসিক, সামাজিক সর্বপ্রকার বা সর্বাঙ্গীণ জীবন বিকাশ।
• শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যা শিশুকাল থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত এবং যা ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিবিধান ও অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করে।
• অর্থাৎ অভিজ্ঞতা অর্জন, আত্মপ্রচেষ্টার মাধ্যমে সামঞ্জস্য বিধান ও পরিপূর্ণ আত্মবিকাশের নামই শিক্ষা।