Friday, 19 February 2021

Philosophy:“চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ" — চার্বাকদের এই উক্তি ব্যাখ্যা ও বিচার করাে।

Leave a Comment

 'Perception is the only source of knowledge' - Explain and examine this statement of the Carvaka.

“চার্বাক মতে প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ" — চার্বাকদের এই উক্তি ব্যাখ্যা ও বিচার করাে‌।

 উত্তর

প্রত্যক্ষ প্রমাণের স্বরূপ: চার্বাক জ্ঞানতত্ত্ব সমগ্র চার্বাকদর্শনের যৌক্তিক ভিত্তি। জ্ঞানের উৎস নির্ণয় করা জ্ঞানতত্ত্বের একটি মৌলিক কাজ। ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন শাখা, বিশেষ করে নৈয়ায়িকরা যথার্থ জ্ঞানের উৎসরূপে চারটি প্রমাণ স্বীকার করেন। যথা— প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান ও শব্দ। জড়বাদী চার্বাকরা কেবলমাত্র প্রত্যক্ষকে যথার্থ জ্ঞানের উৎসরূপে, অর্থাৎ প্রমাণরূপে স্বীকার করেন। এই মতে অনুমান, উপমান ও শব্দ যথার্থ জ্ঞান বা প্রমা উৎপন্ন করতে পারে না। 

প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ । প্রত্যক্ষ দু - প্রকার – মানসপ্রত্যক্ষ ও বাহ্যপ্রত্যক্ষ । সুখ, দুঃখ, বেদনা প্রভৃতি মানস অবস্থার জ্ঞানকে আন্তর বা মানসপ্রত্যক্ষ বলে। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়ের সাহায্যে বাহ্যবস্তুর জ্ঞান হয়। এই ক্ষেত্রে পাঁচটি ইন্দ্রিয় নিজ নিজ বিষয়ের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়। এজন্য ইন্দ্রিয়কে প্রমাণ বলা হয়। এই প্রমাণের নাম প্রত্যক্ষ প্রমাণ। প্রত্যক্ষ প্রমাণের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান হল প্রত্যক্ষ জ্ঞান। 'ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষজন্য জ্ঞান' প্রত্যক্ষের লক্ষণ। ইন্দ্রিয় এবং অর্থের (বিষয়) সন্নিকর্ষের (সম্বন্ধযুক্ত হওয়ার) ফলে প্রত্যক্ষ জ্ঞান পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ বা প্রমা, এই প্ৰমার করণকে প্রত্যক্ষ প্রমাণ বলা হয়েছে।

 চার্বাক ছাড়া ভারতীয় দর্শনের অন্য সম্প্রদায়গুলি প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াও অনুমান, উপমান ও শব্দকে অতিরিক্ত প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করেন। চার্বাকমতে অনুমান প্রমাণ নয়। এটি প্রমা উৎপন্ন করতে পারে না। অনুমানের সাহায্যে পাওয়া জ্ঞান নির্দোষ বা সংশয়মুক্ত নয়। তা ছাড়া প্রত্যক্ষ জ্ঞানের ভিত্তিতে অনুমান প্রমাণ গঠন করা হয় বলে প্রত্যক্ষ প্রমাণকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ বলা যায়। উপমান ও শব্দ প্রমাণ অনুমানের উপর নির্ভর করে। এইজন্য এই দুটিকে সার্থক প্রমাণ বলা যায় না। সুতরাং অনুমান উপমান ও শব্দ এদের কোনােটি যথার্থ জ্ঞান দিতে পারে না। 


প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলার স্বপক্ষে চার্বাকদের যুক্তি :

প্রথমতঃ প্রত্যক্ষের মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব সূচিত হয়: প্রত্যক্ষ হল বস্তুর অস্তিত্বসূচক। যে বস্তুকে প্রত্যক্ষ করা যায় না তার অস্তিত্ব আছে — একথা বলা অর্থহীন। যা প্রত্যক্ষলব্ধ তাই বাস্তব এবং যা প্রত্যক্ষের বহির্ভূত তা অবাস্তব। একটি বৃক্ষকে প্রত্যক্ষ করা যায়, তাই বৃক্ষ অস্তিত্বশীল। এজন্য চার্বাকরা প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলেন।

 দ্বিতীয়তঃ প্রত্যক্ষ জ্ঞান স্পষ্ট ও অভ্রান্ত হয়:  চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান স্পষ্ট ও অভ্রান্ত হয়। প্রত্যক্ষ হল সাক্ষাৎ অনুভব। এখানে ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের মধ্যে সরাসরি সংযােগ হয়। এরূপ অভিজ্ঞতা অন্য কোনাে অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভরশীল নয়। তাই প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞান স্পষ্ট, এই স্পষ্টতা অন্য কোনাে প্রমাণের থাকে না। তাই কেবল  প্রত্যক্ষকেই প্রমাণ বলতে হয়। 

তৃতীয়তঃ প্রত্যক্ষ জ্ঞান সংশয়মুক্ত: চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান নিশ্চিত ও সংশয়শূন্য। তাই একমাত্র প্রত্যক্ষের সাহায্যেই আমরা যথার্থ ও নিঃসন্ধিগ্ধ জ্ঞান লাভ করতে পারি। আমরা আমাদের চক্ষু, কর্ণ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যা জানি তাতে কোনােরূপ সংশয় পােষণ করি না বলেই এই জ্ঞান নিঃসন্ধিগ্ধ ও যথার্থ হয়। অনুমান ও শব্দের মাধ্যমে আমরা যে জ্ঞান লাভ করি, তা সন্দেহমুক্ত নয়। কিন্তু প্রত্যক্ষ জ্ঞান এতই স্পষ্ট যে, এর যাথার্থ্য সম্পর্কে কোনাে সংশয়ের অবকাশ থাকে না। 

চতুর্থতঃ প্রত্যক্ষই মূল প্রমাণ: চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ হল সকল প্রমাণের মূল প্রমাণ। প্রত্যক্ষকে ভিত্তি করেই অনুমান, উপমান, শব্দ প্রভৃতি অন্যান্য প্রমাণগুলি গড়ে উঠেছে। তাই প্রত্যক্ষকে শ্রেষ্ঠ ও মূল প্রমাণ বলে স্বীকার করতে হবে। 

পঞ্চমত, প্রত্যক্ষই সর্বাপেক্ষা বলবান প্রমাণ ও প্রত্যক্ষ হচ্ছে বিভিন্ন প্রকার প্রমাণের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ও উপজীব্য প্রমাণ। অন্য প্রমাণগুলি যেমন — শব্দ প্রমাণ, অনুমান প্রমাণ প্রভৃতি সম্পর্কে কোনাে সংশয় দেখা দিলে সেই সংশয় দূর করার জন্য প্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ কারণে প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ বলাই সংগত। 

ষষ্ঠত, নির্দোষ ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ জ্ঞান সঠিক হয় : চার্বাক দার্শনিকদের মতে, প্রত্যক্ষকে প্রমাণরূপে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোনাে মতবিরােধ নেই। অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ভ্রান্তি দেখা দেয়। কিন্তু সেই ভ্রান্তির কারণ প্রত্যক্ষ নয়। যে দেশে ও কালে বস্তুটি প্রতীয়মান হয়, সেই দেশ ও কালে বস্তুটি নেই বলেই ভ্রান্তি। প্রকৃতপক্ষে, নির্দোষ ইন্দ্রিয়জাত প্রত্যক্ষ জ্ঞান সঠিক, সুপ্রমাণিত ও বিশ্বাসযােগ্য হয়। এই সকল কারণে চার্বাক দার্শনিকগণ প্রত্যক্ষকেই একমাত্র প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করেছেন।

 সমালােচনা: ‘প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ’ — চার্বাকদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নানা আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। 

) চার্বাকদের মতানুযায়ী 'প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমাণ’ — একথা বললে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সবক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষকে প্রমাণ হিসাবে বােঝায়। কিন্তু অতীত ও ভবিষ্যৎ ঘটনার প্রত্যক্ষ কখনােই সম্ভব নয়। এসব ক্ষেত্রে অনুমানের ওপর নির্ভর করতে হয় বা শব্দ প্রমাণের সাহায্য নিতে হয়।

২) চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমরা সাক্ষাৎভাবে বা সরাসরি লাভ করি অর্থাৎ এই জ্ঞান পরােক্ষ জ্ঞান নয়। তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ হয়। কিন্তু জৈন মতে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান সাক্ষাৎ নয় বা স্বনির্ভর নয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইন্দ্রিয়নির্ভর। কাজেই, অনুমানের মতাে প্রত্যক্ষজ্ঞানও অযথার্থ হয়।

৩) চার্বাক মতে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান আমরা সাক্ষাৎভাবে বা সরাসরি লাভ করি অর্থাৎ এই জ্ঞান পরােক্ষ জ্ঞান নয়। তাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান যথার্থ হয়। কিন্তু জৈন মতে, প্রত্যক্ষ জ্ঞান সাক্ষাৎ নয় বা স্বনির্ভর নয়। প্রত্যক্ষ জ্ঞান ইন্দ্রিয়নির্ভর। কাজেই, অনুমানের মতাে প্রত্যক্ষজ্ঞানও অযথার্থ হয়। 

৪) প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলা হলে জ্ঞানের পরিসর অত্যন্ত সীমিত হয়ে পড়বে। কেননা, বৈচিত্র্যময় জগতের অধিকাংশ বিষয়ই প্রত্যক্ষের পরিসরের বাইরে অবস্থিত। তাই জগতের বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করতে হলে প্রত্যক্ষের অতিরিক্ত অনুমান, শব্দ ইত্যাদিকে প্রমাণ হিসাবে স্বীকার করে নিতে হয়। 

৫) যে সকল যুক্তির সাহায্যে চার্বাকগণ অনুমান এবং শব্দকে প্রমাণ হিসাবে অস্বীকার করেছেন, সেই একই যুক্তির সাহায্যে দেখানাে যায় যে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নয়। অনুমান ও শব্দের মতাে প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রেও অনেক সময় ভ্রান্তি ঘটে। যেমন — রজুতে সর্পভ্রম, শুক্তিতে রজতভ্রম ইত্যাদি। কাজেই, অনুমান প্রভৃতি ভ্রান্ত হয় বলে যদি প্রমাণ না - বলা যায় তাহলে প্রত্যক্ষকেও প্রমাণ বলা যাবে না। 

৬) আধ্যাত্মবাদী ভারতীয় দর্শনের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তই অতীন্দ্রিয় বিষয় সম্পর্কিত। এইসব অতীন্দ্রিয় বিষয়ের ( যেমন — ঈশ্বর, আত্মা, পরলােক ইত্যাদি ) ইন্দ্রিয় প্রত্যক্ষ সম্ভব নয়। কাজেই, প্রত্যক্ষ সম্ভব না - হওয়ার জন্য এইসব বিষয়ের জ্ঞান দান করার ব্যাপারে ভারতীয় দার্শনিকগণ অনুমান প্রভৃতি অন্যান্য প্রমাণের সাহায্য নিয়েছেন। সুতরাং, প্রত্যক্ষকে একমাত্র প্রমাণ বলে স্বীকার করা যায় না।

<<<<<<<<<<>>>>>>>>>
If You Enjoyed This, Take 5 Seconds To Share It

0 comments: