Sunday, 4 October 2020

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা কর।

Leave a Comment

    শিক্ষা বিজ্ঞান Education 

 প্রশ্ন: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলতে কী বোঝ? আধুনিক শিশুক্রেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যাবলী আলোচনা কর । 

অথবা,

 শিক্ষার শিশুকেন্দ্রিকতার অর্থ ও তাৎপর্য কী?  


শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা কর।

অথবা, 

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার তাৎপর্য আলোচনা কর ।

 উত্তর: 

   ভূমিকা: যে শিক্ষা ব্যবস্থার সমূহ আয়ােজনই শিশুর সামগ্রিক জীবনের বিকাশের জন্য পরিকল্পিত ও পরিচালিত- সে শিক্ষা ব্যবস্থাই হল শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা। শিশুর প্রয়ােজন ও সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করেই আধুনিক শিক্ষার সমূহ আয়ােজন গড়ে উঠেছে । 

শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা:  প্রাচীন শিক্ষায় শিশু উপেক্ষিত ছিল। সেখানে শিশুর ব্যক্তিসত্তা ও স্বাতন্ত্র্য অদ্ভুতভাবে অবহেলিত ছিল। শিশুকে তাড়াতাড়ি বড় করার জন্য চলত রীতিমত পীড়ন। এই শাসন - পীড়ন যেমন চলত গৃহে, তেমনি চলত বিদ্যালয়ে । সেকালে শিশু ভীতগ্রস্ত ও অনিচ্ছুক মন নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিদ্যালয়ে যেতাে, তারপর বিদ্যালয়ের ছুটি হলে কারণে - অকারণে শাসনের অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন নিয়ে শুকনাে মুখে বাড়ি ফিরে আসত । 

মাস্টার মশাইয়ের নাম শুনলেই ছােটদের মুখ শুকিয়ে যেত, আর পড়ার বই সামনে ধরলেই তাদের ঘুম পেতাে। সুযােগ পেলেই তারা স্কুলে যাওয়ার ভয়ে অন্য জায়গায় লুকিয়ে থাকত। 

আসল কথা সেকালে শিক্ষার পরিবেশ, উপকরণ, কৌশল বা পদ্ধতি- কোনটাই শিশুর শিক্ষার উপযােগী ছিল না। বড়দের প্রয়ােজনবােধ ও খেয়ালখুশি মতােই সেকালের পাঠক্রম ও শিক্ষাদান পদ্ধতি পরিকল্পিত হয়েছিল।

 কিন্তু আধুনিক শিক্ষাচিন্তায় শিশুকে ও তার সামগ্রিক ব্যক্তিসত্তাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করবার জন্য শিশুর মানসিক ও শারীরিক ক্ষমতা বিচার করে বিদ্যালয়ের পরিবেশ পাঠক্রম, শিক্ষায় মনােযােগী করার জন্য বিভিন্ন  পুরস্কার, উপকরণ ও কৌশলের ব্যবহার প্রথা চালু করে আজকের শিশুদের শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছে। এই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার জনক হলেন রুশাে। জন্ অ্যাডামসের ভাষায় আধুনিক শিক্ষা কার্যত শিশুকেন্দ্রিক এবং ঐ শিক্ষার আলােকে বর্তমান শতাব্দী হচ্ছে  শিশুশতাব্দী । 

আধুনিক শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক বলার কারণ:

 আধুনিক শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক বলার কারণ- বড়দের থেকে শিশুদের শেখাররীতি ও পদ্ধতি  সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের মানসিক জগতের চিন্তা, কল্পনা, ধারণার প্রকৃতি ভিন্ন ধরণের। মােটকথা, শিশুর মনােজগৎ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক জগৎ। বড়দের জগতের সঙ্গে শিশুদের জগতে বিস্তর ব্যবধান। তাছাড়া সেই জগতের অধিবাসী হিসেবে সব শিশু এক রকমের হয় না। প্রত্যেকেরই শারীরিক ও মানসিক সামর্থ ভেদে শেখার ক্ষমতা আলাদা আলাদা। সে জন্যই একালের শিক্ষাকে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলা হয়ে থাকে। 

আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যাবলী: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার কতকগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছে । যেমন- 

১) আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক  শিক্ষার ধারণা: প্রাচীন ধারণানুযায়ী শিক্ষা ছিল জ্ঞান আহরণের কৌশলমাত্র। কিন্তু আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার শিক্ষা শব্দকে অনেক বেশি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষা হল শিশুর জীবনে এক ধরণের অভিযােজন প্রক্রিয়া। শিক্ষার এই তাৎপর্য শিশুর জীবনভিত্তিক এবং শিশুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক।

২) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্যঃ আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য হল ব্যক্তির কল্যাণের মাধ্যমে সমাজকল্যাণ সাধন করা। এই প্রসঙ্গে জন ডিউই বলেছেন— “ শিক্ষার লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার বাড়িয়ে তুলে তার সামাজিক যােগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলা।"

 ৩) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পাঠক্রম: প্রাচীন ধারণানুযায়ী সার্থক শিক্ষার পাঠক্রমের মধ্যে থাকবে সমাজের অতীত অভিজ্ঞতা। কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠক্রমের নতুন গতিধর্মী সংব্যাখ্যান দেওয়া হয়েছে। এই পাঠক্রম হবে পরিবর্তনশীল এবং জীবনভিত্তিক। শিশুর এবং সমাজের চাহিদা উভয়কে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই পাঠক্রমে।

 ৪)  শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতি:  আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষণ পদ্ধতি মনােবিজ্ঞানসম্মত। শিশুর আগ্রহ, ক্ষমতা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন— ডাল্টন পরিকল্পনা, প্রােজেক্ট পদ্ধতি, বুনিয়াদী শিক্ষা পরিকল্পনা, উইনেটকা পরিকল্পনা ইত্যাদি ইত্যাদি। 

৫)  শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষকের কাজ ও দায়িত্বের পরিবর্তন ও বিস্তৃতি ঘটেছে। তার দায়িত্ব হল শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশে সাহায্য করা। শিক্ষক মহাশয় তাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব, নিজের কুশলতা ও সমবেদনামূলক মনােভাবের এবং জীবন দর্শনের শিক্ষার্থীকে প্রভাবিত করবেন। তিনি হবেন শিক্ষার্থীর বন্ধু, নির্দেশক এবং জীবন দর্শনের প্রতীক ।

 ৬) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় বিদ্যালয়:  শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষালয়ের বৈশিষ্ট্য হল শিক্ষালয় হবে সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। এখানে শিক্ষালয়কে সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে সংগঠিত করার কথা বলা হয়েছে।

 ৭) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় খৃঙ্খলা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় মুক্ত শৃঙ্খলা বা স্বতঃস্ফূর্ত শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীন ধারণানুযায়ী শিশুর স্বতঃস্ফুর্তইচ্ছাকে দমন করার পরিবর্তে স্বাভাবিক ও স্বাধীনতা দান করা হয়েছে।

 ৮)  শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও সক্রিয়তা : আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিশুর সক্রিয়তার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ শিক্ষার্থী হাতে - কলমে কাজ করে নিজে যা শিখবে, তাই হবে তার প্রকৃত শিক্ষা। 

৯)  শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা : এখানে বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে শিক্ষা দেওয়ার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষাকে অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিক্ষাও বলা যায়। 

১০) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও সৃজনশীলতা : শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সৃজনী স্পৃহাকে চরিতার্থ করার চেষ্টা করা হয় এবং বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে তার সৃজনাত্মক ক্ষমতার উন্মেষ সাধন করা হয়।

 ১১) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও সহপাঠক্রমিক কার্যাবলী: খেলাধূলা, সাহিত্যচর্চা, ভ্রমণ ইত্যাদির মত কাজগুলি এই নতুন তাৎপর্যে সহপাঠ্যক্রমিক নামে সংযােজিত হয়েছে ।


 ১২) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ও স্বাধীনতা: সবশেষে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষার্থীকে শিক্ষাক্ষেত্রে অবাধ স্বাধীনতাদানের নীতি ঘােষণা করেছে। তার এই স্বাধীনতার অর্থ উচ্ছঙ্খৃলতা নয়। অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে শিশুরা যাতে নিজেরাই নিজেদের শৃঙ্খলিত করতে পারে তার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থায়।


মন্তব্য: সুতরাং উপরিউক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, শিশুর পরিপূর্ণ জীবনবিকাশে এবং সমাজের গতানুগতিকতাকে বর্জন করে কল্যাণকারী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।


If You Enjoyed This, Take 5 Seconds To Share It

0 comments: