প্রশ্ন: দর্শনের আলোচ্য বিষয় বা পরিসর (Scope of Philosophy) আলোচনা করো.
উত্তর:
দর্শনের আলােচ্য বিষয় বা পরিসর: দর্শনের আলােচ্য বিষয়গুলিকে নিয়েই দর্শনের পরিসর বা পরিধি। জড়, জীবন, ইন্দ্রিয়, মন, প্রাণ, জীবাত্মা, পরমাত্মা — সবই দার্শনিক আলােচনার বিষয়।
এদিক থেকে দেখতে গেলে দর্শনের আলােচনার পরিধি বিরাট। সমগ্র জগই দর্শনের আলােচনার বিষয়। জগৎ সম্পর্কে ন্যায়সঙ্গত বিচার - বিশ্লেষণ করে, মানুষের জীবনের প্রকৃত মূল্যায়ন করে বিশ্বের সাথে তার সম্পর্ক নির্ণয় করা দর্শনের কাজ। জনৈক পাশ্চাত্য দার্শনিক মন্তব্য করেছেন যে স্বর্গ ও মর্ত্যের এমন কোন বিষয় নেই যা দার্শনিক আলােচনার গণ্ডীর বাইরে বা যা নিয়ে দার্শনিক অনুসন্ধান চালানাে যায় না। সমাজ, শিক্ষা, কলা, বিজ্ঞান, ধর্ম, নীতি, অহিংসা, শান্তি প্রভৃতি বিষয়সমূহের ওপরেও দার্শনিক ব্যাখ্যা এগিয়ে যেতে পারে। এখন দর্শনের আলোচ্য বিষয়বস্তুকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে।
(১) অবভাস সংক্রান্ত আলােচনা : বাহ্যজগতের প্রতিটি বস্তুর দুটি রূপ আছে। একটি হল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ বা অবভাস এবং অপরটি হল বস্তুম্বরূপ। আমরা বস্তু বা বিষয়ের যে বাহ্যরূপ প্রত্যক্ষ করি সেটি হল বস্তুর অবভাস (Appearance)। বস্তুর এই অবভাস সংক্রান্ত আলােচনা করে রূপবিদ্যা বা প্রতিভাস বিজ্ঞান ( Phenomenology )। বস্তুত ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতার জগৎ তথা অবভাসিক জগৎ নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে দর্শনকে বিভিন্ন প্রতিভাস বিজ্ঞানের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করতে হয়। এইসব সিদ্ধান্তকে বিচারবিশ্লেষণ করে তাদের সমন্বিত বা ঐক্যবদ্ধ করাই হল দর্শনের লক্ষ্য।
(২) বস্তুম্বরূপ সংক্রান্ত বা অধিবিদ্যা বিষয়ক আলােচনা: বস্তুর আসল রূপকে বলা হয় বস্তুস্বরূপ। প্রকৃতপক্ষে বস্তুর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা অবভাসিত রূপের অন্তরালে তার একটি প্রকৃত সত্তা (Reality) আছে, যাকে বাইরে থেকে আমরা দেখতে পাই না। বস্তুর এরূপ সত্তাই হল বস্তুসত্তা বা তত্ত্ব। অবভাস পরিবর্তনশীল কিন্তু বস্তুস্বরূপ নিত্য বা অপরিবর্তনীয়। দর্শনের অন্যতম শাখা হিসাবে অধিবিদ্যা (Metaphysics) বস্তুর স্বরূপ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। অর্থাৎ জড়, প্রাণ, মন, আত্মা, ঈশ্বর, পরমসত্তা, দেশ, কাল, কার্যকারণ সম্পর্ক প্রভৃতির যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কিত সমস্যাগুলির আলােচনা করে দর্শনের যে শাখা তার নাম অধিবিদ্যা।
(৩) জ্ঞান সংক্রান্ত আলােচনা: দর্শনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল জ্ঞান সম্পর্কিত আলােচনা। জ্ঞানের স্বরূপ, জ্ঞানের উৎস, জ্ঞানের সীমা, জ্ঞানের শর্ত, যথার্থ জ্ঞান আদৌ সম্ভব কিনা — এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলােচনা করে দর্শনের যে শাখা, তাকে বলা হয় জ্ঞানবিদ্যা ( Epistemology)।
(৪) আদর্শ বা মূল্যের স্বরূপ বিষয়ক আলােচনা: মানবজীবনের মূল আদর্শ বা পরমমূল্য হিসাবে সত্য, শিব ও সুন্দরের আলােচনা করে যে শাস্ত্র, তাকে বলা হয় মূল্যবিদ্যা (Aviology)। সত্য বলতে চিন্তার আদর্শকে, ‘শিব’ বলতে মহৎ আচরণের আদর্শকে এবং ‘সুন্দর’ বলতে অনুভূতির আদর্শকে বােঝানাে হয়। দর্শন এই তিনটি পরমমূল্যের সাহায্যে পরম সত্তার স্বরূপ এবং জগৎ ও জীবনের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলির মূল্য অবধারণ করে থাকে। কাজেই মূল্যবিদ্যা সংক্রান্ত আলােচনা দর্শনের বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্ত।
(৫) ধর্ম সম্পর্কিত আলােচনা: জীবনের সত্যকে যা ধারণ করে রাখে তাই হল ধর্ম। তাই ধর্ম সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল অপরিসীম। এই ধর্ম - বিষয়ক বিভিন্ন ধারণা যেমন — ঈশ্বর, ধর্মীয় চেতনা, আত্মার স্বরূপ, অমঙ্গল প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য আলােচনা করে দর্শনের যে শাখা, তাকে বলা হয় ধর্মদর্শন।
(৬) সমাজ বিষয়ক আলােচনা: সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে মানুষ সামাজিক জীবনযাপনের জন্য বিভিন্নপ্রকার সংঘ, প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলে। সমাজের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলির স্বরূপ, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ভূমিকা প্রভৃতি আলােচনা করা দর্শনের কাজ। দর্শনের যে শাখায় এই বিষয়সমূহ আলােচিত হয়, তাকে বলা হয় সমাজদর্শন।
(৭) রাষ্ট্রসম্পর্কীয় আলােচনা: দর্শনের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে রাষ্ট্রদর্শন রাষ্ট্রের উৎপত্তি, রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক ঘটনার মূল্যায়ন, শাসনব্যবস্থা, স্বাধীনতা, সাম্য, গণতন্ত্র প্রভৃতি প্রত্যয়গুলির বিশ্লেষণ ও অর্থ নির্ণয় করে।
অবশেষে বলা যায়, আমরা যে জগতে বসবাস করি তা বিচিত্র রহস্যে ও বৈচিত্র্যপূর্ণ গতিতে ভরপুর। এই পরিদৃশ্যমান জগৎ নিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই জগৎ সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতাও পরিবর্তনশীল। বিভিন্ন বিজ্ঞান এই সমস্ত অভিজ্ঞতার এক একটি দিক নিয়ে আলােচনা করে মাত্র। কিন্তু দর্শন আমাদের সামগ্রিক অভিজ্ঞতাকে তার আলােচ্য বিষয় সূচির অন্তর্ভুক্ত করে। অর্থাৎ , জগৎ ও জীবন সম্পর্কে মানুষের সামগ্রিক অভিজ্ঞতাও দর্শনের পরিধির অন্তর্ভুক্ত।
<<<<<<<<<<<<<<<<<The End>>>>>>>>>>>>>
0 comments:
Post a Comment