শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা বলতে কী বোঝ? আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।
উঃ
ভূমিকা: প্রাচীন শিক্ষায় শিশু ছিল উপেক্ষিত। সেখানে শিশুর ব্যক্তিসত্তা ও স্বাতন্ত্র্য ছিল অদ্ভুতভাবে অবহেলিত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষা চিন্তায় শিশুকে ও তার সামগ্রিক ব্যক্তিসত্তাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য চাঞ্চল্যকর শিক্ষাতত্ত্ব উপস্থাপন করেছে শিক্ষাধিনায়ক রুশো। শিশুকে এখন আর বয়স্ক মানুষের ক্ষুদ্রতর সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা না করে শিশু হিসেবেই শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আধুনিক শিক্ষায় এসেছে জন অ্যাডামসের ভাষায় শিশু কেন্দ্রিকতা। জন এডামস এর ভাষায় আধুনিক শিক্ষা কার্যত শিশুকেন্দ্রিক এবং শিক্ষার আলোকে বর্তমান শতাব্দি হচ্ছে শিশু শতাব্দি।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার সহজ অর্থ হলো শিশুকে কেন্দ্র করে শিক্ষা পদ্ধতি বা শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়া। শিশুর শারীরিক, মানসিক, আনুভুতিক ও সামাজিক বিকাশের ভিতর তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ব গঠনের পথ প্রশস্ত হবে। শিক্ষার কেন্দ্রে শিক্ষার্থীর সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্থান দিতে হবে। শিক্ষার্থীর গ্রহণ ক্ষমতার ও মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে পাঠদানের পদ্ধতি নির্বাচন করতে হবে। পাঠ্যক্রম শিশুর জন্য, বিদ্যালয় শিশুর জন্য। এককথায় সমগ্র শিক্ষাই শিশুর জন্য। শিক্ষক,অভিভাবক এখানে গৌণ ব্যক্তি, সহায়ক মাত্র, প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রক নয়। এটাই হলো আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য।
শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বৈশিষ্ট্য গুলি উল্লেখ করা হলো -
১) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার ধারণা: প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী শিক্ষা ছিল জ্ঞান আহরণের কৌশল মাত্র। শিক্ষক ছিলেন জ্ঞানের ভান্ডার। কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষা শব্দকে অনেক বেশি ব্যাপক ও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থে ব্যবহার করা হচ্ছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের জীবনে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের প্রক্রিয়া চলছে, তাই হল আধুনিক অর্থে শিক্ষা। শিক্ষা হলো শিশুর জীবনে এক ধরনের অভিযোজন-প্রক্রিয়া (Adjustment Process)। শিক্ষার এই তাৎপর্য শিশুর জীবন ভিত্তিক এবং শিশুকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয়।
২) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য: আধুনিক শিশু কেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য ব্যক্তিসত্তা বিকাশ করা এবং সামাজিক কল্যাণ সাধন করা। একক মানব শিশু সমাজ ছাড়া বাঁচতে পারে না, আবার ব্যক্তির উন্নতি না হলে সামাজিক উন্নতি হয় না। তাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো ব্যক্তির কল্যাণের মাধ্যমে সমাজ কল্যাণ সাধন করা। এই প্রসঙ্গে জন ডিউই বলেছেন, "শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভান্ডার বাড়িয়ে তুলে তার সামাজিক যোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলা।"
৩) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পাঠক্রম: প্রাচীন ধারণা অনুযায়ী সার্থক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের মধ্যে থাকবে সমাজের অতীত অভিজ্ঞতা। কিন্তু শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ্যক্রমের নতুন গতিধর্মীর ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। এই পাঠ্যক্রম হবে পরিবর্তনশীল এবং জীবন ভিত্তিক। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ মনরো বলেছেন, অতীত অভিজ্ঞতাকে বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলে ধরাই শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পাঠ্যক্রমের উদ্দেশ্য।
৪) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার পদ্ধতি: আধুনিক শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো সেগুলি মনোবিজ্ঞানসম্মত। শিশুর আগ্রহ, ক্ষমতা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষণ পদ্ধতিকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন - ডাল্টন পরিকল্পনা, উইনেটকা পরিকল্পনা, বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনা ইত্যাদি।
৫) শিক্ষকের ভূমিকা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষকের ভূমিকা হল শিশুর সর্বাঙ্গীণ বিকাশে সাহায্যকারী একজন ব্যক্তি- যিনি বাইরে থেকে শিক্ষার্থীদের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেবেন না। তিনি হবেন বন্ধু, নির্দেশক ও জীবনদর্শনের পথিক।
৬) শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা শিক্ষালয়: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় শিক্ষালয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো শিক্ষালয় হবে সমাজের ক্ষুদ্র সংস্করণ। তাই শিক্ষালয়কে সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে সংগঠিত করার কথা বলা হয়েছে।
৭) সক্রিয়তা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সক্রিয়তা। শিশুর দেহ-মন যাতে স্বাধীনভাবে ক্রিয়া করতে পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। শিক্ষার্থী হাতে-কলমে কাজ করে যা শিখবে তাই হবে তার প্রকৃত শিক্ষা।
৮) স্বাধীনতা: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষায় মুক্ত শৃঙ্খলা বা স্বতঃস্ফুর্ত শৃঙ্খলার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অবাধ স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে শিশুরা যাতে নিজেরাই নিজেদের শৃঙ্খলিত করতে পারে তার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয় এই শিক্ষা ব্যবস্থায়।
৯) সৃজনশীলতা: শিশু যখন নিজের ইচ্ছায় নিজের গৃহীত আদর্শে দিনে দিনে নিজের ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলে তখন তাকে সৃজনশীল শিক্ষা বলে। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার বৈশিষ্ট্য হলো সৃজনশীলতা। সৃজনশীলতা শিশুর স্বাধীনতার একটি উচ্চ অর্থ ও মান নির্দেশ করে দেয়।
১০) ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ বিকাশ: শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষা সুপ্ত ব্যক্তির পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে চেষ্টা করে। প্রাপ্ত বয়স্কদের ব্যক্তিত্ব সুপ্তভাবে শিশুর মধ্যেই থাকে। শিশুর বিকাশ নির্ভর করে তার সহজাত সামর্থ্যগুলির ক্রমবিকাশ এবং এগুলির কাজে লাগাবার উপর। শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার লক্ষ্য হলো শিশুর সামর্থ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ।
মন্তব্য: উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনার প্রেক্ষিতে একথা সহজেই বলা যায় যে, শিশুর পরিপূর্ণ জীবনবিকাশে এবং সমাজের গতানুগতিকতাকে বর্জন করে কল্যাণকারী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে শিশুকেন্দ্রিক শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।
************ ******** ***********
1 comments:
Great post | You write very well, I learned many things from your blog which were unknown
Post a Comment