প্রশ্ন : সংস্কৃতি কাকে বলে? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যগুলি আলােচনা করাে।
উত্তর:
সংস্কৃতির সংজ্ঞা (Definition) : এডওয়ার্ড টাইলরের মতে, সংস্কৃতি বলতে বােঝায় মানুষের জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, আইন, প্রথা ইত্যাদির জটিল মিলন এবং অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ে তার দক্ষতা ও অভ্যাস যেটা সে সমাজের সদস্য হিসেবেও আয়ত্ত করে।
পিটার ওর্সলের ( Peter Worsley ) মতে, সংস্কৃতি বলতে বােঝায় সামাজিক উৎপাদন ও সম্পদ যা শিক্ষার দ্বারা একটি প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।
বায়ারস্টেড ( Bierstedt) এর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে একটি জটিল সমন্বয় যা সমাজের সদস্য হিসেবে একজন মানুষ চিন্তা করে, কোন কিছু করে এবং যা তাদের থাকে।
সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কুলী, এনজেল ও কার ( Cooley, Angel and Car ) বলেন, একত্রে বাস করার সঠিক ফলশ্রুতি যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত- তাই হচ্ছে সংস্কৃতি। সমাজতাত্ত্বিক রস বলেন, সংস্কৃতি হচ্ছে সামগ্রিকভাবে মানুষের অর্জিত আচরণ পদ্ধতি যা অনুকরণ অথবা নির্দেশনায় মাধ্যমে বর্তায়। প্রখ্যাত সমাজ নৃ-তাত্ত্বিক মালিনাউস্কির (Malinowski) মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে মানব সৃষ্ট এমন কৌশল বা উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করে।
রালফ্ লিনটন ( Ralph Linton ) সংস্কৃতির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন-- সংস্কৃতি হচ্ছে মানব আচরণের সামাজিক রূপ যা মানুষ কোনও সমাজে বয়স্কদের থেকে গ্রহণ করে এবং পরবর্তী প্রজন্মে তা বাহিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে একটি কুঠার মানুষের তৈরি জিনিস বলে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এই হাতিয়ারটি তার কাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ সংস্কৃতি মানুষের সৃষ্টি জিনিসের চেয়ে বরং জিনিসগুলির উপযােগিতা ও ব্যবহারের প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করে।
প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্কের ভিত্তিতে কোয়েনিগ (Koening) সংস্কৃতির সংজ্ঞা নিরূপণ করেছেন। তার মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে মানুষের সার্বিক প্রচেষ্টার ফল যা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে জীবনপ্রণালীকে উন্নত করে। মানুষই একমাত্র প্রাণী যারা যে কোন অবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে এবং নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে। বেঁচে থাকার প্রয়ােজনীয় বস্তুণ্ডলির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে, সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, যাকে এক কথায় সংস্কৃতি বলা যায়।
সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য সমূহ :
১। সংস্কৃতি হল মানুষের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জীবনযাপনের ধারার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা। মনুষ্যেতর প্রাণীর পক্ষে কোন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে তােলা সম্ভব নয়। সংস্কৃতিবিহীন মানবসমাজের কথা কল্পনা করা যায় না।
২। সংস্কৃতি সহজাত নয়। অভিজ্ঞতা, অনুশীলন ও চর্চার মাধ্যমে সংস্কৃতিকে রপ্ত করতে হয়। সংস্কৃতি আহরণের এই প্রক্রিয়াকে সমাজতত্ত্বের পরিভাষায় সামাজিকীকরণ (Socialization) বলে অভিহিত করা হয়।
৩। বস্তুগত ও অবস্থাগত উভয় উপাদানের সংমিশ্রণে সংস্কৃতি গঠিত হয়। জৈবিক, পরিবেশগত, মনস্তাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক বিভিন্ন উপাদান থেকে সংস্কৃতি গঠিত।
৪। সংস্কৃতি সদা পরিবর্তনশীল। সংস্কৃতি নিষ্ক্রিয় বা একপেশে কোন বিষয় নয়। সংস্কৃতির অভিযােজনমূলক (adaptive) চরিত্র পরিবর্তনশীলতার গুরুত্বপূর্ণ কারণ। জ্ঞান - বিজ্ঞানের উন্নতি, রাষ্ট্রের কার্যাবলীর ব্যাপকতা ও জটিলতা বৃদ্ধি এবং মানুষের জীবনযাত্রার মানে (quality of life) পরিবর্তন সংঘটিত হওয়ার জন্য মানব সংস্কৃতিরও পরিবর্তন ঘটে ।
৫। সংস্কৃতি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত শিক্ষা বা অনুশীলনের বিষয় নয়। সমাজের সদস্য হিসেবেই মানুষ সামাজিকীকরণের মাধ্যমে সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় যে সংস্কৃতি হল যৌথ এবং অংশীদারমূলক ( shared )।
৬। সংস্কৃতি শূন্যে অবস্থান করে না। সংস্কৃতি হচ্ছে কাঠামােভিত্তিক। কাঠামােভিত্তিক রূপের মাধ্যমে সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে। সংস্কৃতির এই রূপটি বস্তুগত বা অবস্তুগত উভয় ধরনেরই হতে পারে।
৭। সংস্কৃতি সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি, শুধু মানুষই সংস্কৃতির অধিকারী। সংস্কৃতি সামাজিক অবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিতও।
৮। সামাজিক অবস্থা ভেদে সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য যেমন আছে, তেমনি সাদৃশ্যও আছে। মানুষের ধ্যান - ধারণা, আচার - আচরণ ও সংগঠনের মাধ্যমে প্রকাশিত সংস্কৃতি সর্বযুগে ও সব জায়গায় এক রকম হয় না।
৯। সংস্কৃতির মধ্যে যেমন আদান - প্রদান হয় আবার এর মধ্যে দ্বন্দ্বও দেখা যায়।
১০৷ মানব সংস্কৃতির বৈচিত্র্য অত্যন্ত স্পষ্ট। আচার - আচরণ এক সংস্কৃতি থেকে অন্য সংস্কৃতিতে ভিন্ন। যেমন ইউরােপিয়ান সমাজে যে আচরণগুলিকে স্বাভাবিক বলে মনে করা হয় অন্য সমাজে অনেক সময় তা স্বাভাবিক বলে নাও ভাবা হতে পারে। প্রতিটি সংস্কৃতির নিজস্ব আচরণের ধারা আছে যা অন্য সংস্কৃতি থেকে অনেকাংশে আলাদা।
<<<<<<<<<<<The End >>>>>>>>>>>>
0 comments:
Post a Comment