প্রশ্ন: সাংখ্যদর্শনের বিবর্তনবাদ / পরিণামবাদ / অভিব্যক্তিবাদ আলোচনা কর।
উঃ
সাংখ্য বিবর্তনবাদ: সাংখ্যদর্শন দ্বৈতবাদী। এই দর্শনে দুটি তত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। একটি পুরুষ অপরটি প্রকৃতি। প্রকৃতি ও পুরুষের সংযোগের ফলে এই জগতের আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃতি হতে এই জগতের আবির্ভাব। প্রকৃতিতে এই জগতের লয়। সত্ত্ব, রজঃ, তমো এই গুণ তিনটির সাম্যবস্থা হল প্রকৃতি। প্রকৃতি পরিণামী। নিজ স্বভাহেতু প্রকৃতির নিয়মিত সৃষ্টি করে থাকে। এই পরিণাম দুই প্রকার -- স্বরূপ পরিণাম ও বিরূপ পরিণাম। প্রলয় কালে যে পরিনাম হয় তাকে স্বরূপ পরিণাম এবং সৃষ্টিদশায় যে পরিনাম হয় তাকে বিরূপ পরিণাম বলে।
প্রকৃতির এই পরিণাম যান্ত্রিক নয়। প্রকৃতি জড়, অচেতন হলেও তার এই পরিনাম উদ্দেশ্যমূলক। প্রকৃতি পরিণামের দুটি উদ্দেশ্য -- একটি পুরুষের ভোগ, অপরটি মোক্ষ। পুরুষের ভোগের জন্য প্রকৃতির সৃষ্টিকার্য যেমন প্রয়োজন মোক্ষের জন্যও পুরুষের পক্ষে প্রকৃতির প্রয়োজন।
সাংখ্য মতে প্রকৃতি জগতের উপাদান কারণ। উৎপত্তির পূর্বে কার্য কারণে সৎ। জগৎ, কার্য, প্রকৃতিতে অব্যক্ত রূপে থাকে। প্রকৃতির পরিণামের ফলে জগতের অভিব্যক্তি। চেতন পুরুষ ও সক্রিয় প্রকৃতির সংযোগের ফলে পরিণাম শুরু হয়। পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগের ফলে গুণত্রয়ের মধ্যে বিক্ষোভ ঘটে। তাদের সাম্যবস্থা নষ্ট হয়। এর ফলে প্রকৃতির মধ্যে প্রবল আলোড়ন শুরু হয়। প্রতিটি গুণ অপর দুটি গুণকে অভিভূত করতে চেষ্টা করে। এর ফলে বিভিন্ন পরিমাণে গুনগুলির বিন্যাস ঘটে। বিভিন্ন জাগতিক বস্তু এর ফলে সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি থেকে জড়জগতের ক্রমাভিব্যক্তি নিম্নরূপ:
পুরুষ + প্রকৃতি
মহৎ( বুদ্ধি)
অহংকার
|
|-----------|--------------------------------------------|----
মন পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় পঞ্চকর্মেন্দ্রিয় পঞ্চতন্মাত্র
পঞ্চমহাভূত
মহৎ বা বুদ্ধি: মহৎ বা বুদ্ধি প্রকৃতির প্রথম পরিণাম। জাগতিক বস্তু সৃষ্টির বীজ বলে একে মহৎ বা বিরাট বলা হয়। মহৎ থেকেই সৃষ্টি শুরু। আবার জীবের মধ্যে বুদ্ধি রূপে প্রকাশিত হয় বলে এর অপর নাম বুদ্ধি। ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য, বুদ্ধির সাত্ত্বিক রূপ; অধর্ম' অজ্ঞানতা, মোহ বুদ্ধির তামসরূপ। বুদ্ধি চেতন পুরুষ থেকে ভিন্ন। কিন্তু পুরুষের চৈতন্য বুদ্ধিতে প্রতিবিম্বিত হয়। ইন্দ্রিয়, মন, অংকার বুদ্ধির জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। বুদ্ধির জন্য প্রকৃতি ও পুরুষের ভেদ জ্ঞান হয়।
মন: মনের সাহায্য ছাড়া কোন ইন্দ্রিয় কাজ করতে পারে না। মন জ্ঞানেন্দ্রিয় ও কর্মেন্দ্রিয় উভয়ই -- পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, ও মন এই হল একাদশ ইন্দ্রিয়। মন সূক্ষ্ম অথচ সাবয়ব। মন নিত্য ও পরমাণু পরিমাণ নয়। সাংখ্য মতে মন হলো অনিত্য।
অহংকার: অহংকার প্রকৃতির দ্বিতীয় পরিণাম। মহৎ বা বুদ্ধি থেকে প্রত্যক্ষভাবে অহংকারের আবির্ভাব হয়। আত্মাভিমান ও সমত্ববুদ্ধি অহংকারের ধর্ম। অহংকারের জন্য পুরুষ নিজেকে কর্তা ও ভোক্তা মনে করে। সত্ত্ব রজঃ ও তমোগুণের তারতম্য হেতু অহংকার তিনপ্রকার -- সাত্ত্বিক রাজস ও তামসা। সাত্ত্বিক অহংকার থেকে পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয় ও মনের আবির্ভাব হয়। তামস অহংকার থেকে পঞ্চতন্মাত্রের আবির্ভাব হয়। রাজস অহঙ্কার উভয়ের উৎপত্তিতে সাহায্য করে।
পঞ্চতন্মাত্র: রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ ও স্পর্শ - এই পাঁচটি পঞ্চতন্মাত্র। পঞ্চতন্মাত্র থেকে পঞ্চভূতের সৃষ্টি হয়। ক্ষিতি, অপ্, তেজ, মরুৎ, ও ব্যোম্ -- এই পাঁচটি পঞ্চভূত। পঞ্চ তন্মাত্র থেকে পঞ্চ মহাভুতের আবির্ভাব নিম্নলিখিত উপায়ে হয়।
(১) শব্দতন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয় ব্যোম আকাশ। শব্দ আকাশের গুণ।
(২) শব্দতন্মাত্রের সঙ্গে স্পর্শতন্মাত্রের সংযোগের ফলে মরুৎ বা বায়ুর উৎপত্তি হয়। শব্দ ও স্পর্শ বায়ুর গুন।
(৩) রূপ তন্মাত্রের সঙ্গে শব্দ স্পর্শ তন্মাত্রের সংযোগে তেজের উৎপত্তি হয়। শব্দ, স্পর্শ, রূপ তেজের গুন।
(৪) রস তন্মাত্র শব্দ, স্পর্শ ও রূপ তন্মাত্রের মিলিত হলে অপ্ বা জলের উৎপত্তি হয়। শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস জলের গুন।
(৫) গন্ধ তন্মাত্র শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস তন্মাত্রের সঙ্গে যুক্ত হলে ক্ষিতি বা পৃথিবীর উৎপত্তি হয়। শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ পৃথিবীর গুণ।
মহৎ থেকে মহাভুত অবধি প্রকৃতির এই পরিণামমকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-- প্রত্যয় বা বুদ্ধি সর্গ এবং তন্মাত্র বা ভৌতিক সর্গ। প্রত্যয় সর্গের অন্তর্গত হল- মহৎ, অহংকার, মন, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়। তন্মাত্র সর্গের অন্তর্গত হল পঞ্চ তন্মাত্র, পঞ্চভূত মহাভুত ও মহাভুত থেকে উৎপন্ন সকল দ্রব্য। মহৎ থেকে পঞ্চ মহাভুতের আবির্ভাবকে অনুলোম পরিণাম বলা হয়। এর বিপরীত পরিণামমকে অর্থাৎ প্রলয়কালে যে পরিণামম হয় তাকে প্রতিলোম পরিণামম বলে।
<<<<<>>>>>