বৈশেষিক দর্শন
প্রশ্ন: বৈশেষিক মতে, অভাব কি? অভাব কয় প্রকার? অভাবকে কি ভাবে জানা যায় ? ( What is Abhava according to to Vaisesika? What are its different kinds? How Abhava is known?)
উঃ
অভাব: অভাব মানে কোন কিছু নেই। যার অস্তিত্ব নেই, তাই অভাব। কোন কিছু নেই এটা তাে অস্বীকার করা যায় না। দিনের আকাশে তারা নেই, অমাবস্যায় চাদ নেই, গরমকালে শীত নেই: —কোন - না - কোন কিছুর অভাব কোনা কোন সময় বােঝা যায়ই। তাই অভাবকে না মেনে উপায় নেই। শীতের বেলায় গাছের শাখার দিকে তাকিয়ে ডালগুলি আছে বুঝি কিন্তু পাতার অভাব তাে অস্বীকার করা যায় না। তাই ভাবপদার্থ যেমন আছে অভাবকেও পদার্থ হিসাবে স্বীকার করতেই হয়।
অভাবের প্রকার: অভাব দু'প্রকার, যথা — সংসৰ্গাভাব ও অন্যোন্যাভাব।
সংসৰ্গাভাব: সংসৰ্গাভাব বলতে কোন বস্তুতে অন্য বস্তুর অভাব বােঝায়। যেমন, 'কলসীতে জল নেই' — এখানে কলসীতে জলের অভাব রয়েছে বা কলসীর সঙ্গে জলের সংসর্গের অভাব প্রকাশ পাচ্ছে।
অন্যোন্যাভাব: অন্যোন্যাভাব বলতে এক বস্তু আর এক বস্তু নয় ( ক — খ নয় ) বােঝায়। অন্যোন্যাভাব হল দুটি স্বতন্ত্র বস্তুর মধ্যে অভিন্নতার অভাব। যেমন , হাতি - ঘােড়া নয়, চেয়ার - টেবিল নয়।
সংসর্গাভাব তিন প্রকার— (ক) প্রাগভাব, (খ) ধ্বংসাভাব ও (গ) অত্যন্তাভাব ।
(ক) প্রাগভাব: প্রাক বা পূর্ববর্তী অভাবই প্রাগভাব। কোন বস্তু সৃষ্ট বা উৎপন্ন হওয়ার পূর্বে বস্তুর যে অভাব থাকে, তাই প্রাগভাব। যেমন — সিমেন্ট, বালি, ইট, লােহা দিয়ে পাকাবাড়ি তৈরি হবে। সুতরাং এখন পাকাবাড়ি নেই। নির্মিত হওয়ার পূর্বে সিমেন্ট, বালি, ইট, লােহার মধ্যে পাকাবাড়ির যে অভাব আছে, তাই হল প্রাগভাব। প্রাগভাবের আদি নেই, অথচ অন্ত আছে। পাকাবাড়ি নির্মিত হওয়ার পূর্বে উপরিউক্ত উপাদানের মধ্যে পাকাবাড়ির অস্তিত্ব ছিল না। পাকাবাড়ি নির্মিত হওয়ার পূর্বে পাকাবাড়ির অভাবের কোন আদি নেই। কিন্তু যেই বাড়িটি নির্মিত হল, সেই মুহূর্তে পাকাবাড়ির প্রাগভাব লােপ পেয়ে গেল, তাই প্রাগভাবের অন্ত বা শেষ আছে।
(খ) ধ্বংসাভাব ঃ উৎপন্ন হওয়ার পর কোন বস্তু ধ্বংস হয়ে গেলে তার যে অভাব, তাই ধ্বংসাভাব। একটি মাটির কলসী ভেঙে গেলে কলসীটির ধ্বংসাভাব ঘটে। কলসীটি ভেঙে গিয়ে টুকরোগুলি ছিটিয়ে ছড়িয়ে থাকে। কিন্তু টুকরােগুলির মধ্যে কলসী নেই। ধ্বংসাভাবের যদিও আদি আছে, তবু অন্ত নেই । কলসীটি কোন এক সময়ে ধ্বংস হয়েছে, তাই কলসীটির উৎপত্তির আরম্ভ বা আদি আছে। কিন্তু কলসীটির অন্ত নেই, কেননা সেই কলসীটি আর তৈরি করা যাবে, যেটি ভেঙে গেল। যদিও একই রকম আর একটি নতুন মাটির কলসী তৈরি করা যায়, কিন্তু যে মাটির কলসী ভেঙে গেল, ঠিক সেই কলসীটিকে তৈরি করা সম্ভব নয়। বস্তুর ধ্বংসজনিত অভাব রয়ে যায়, ধ্বংসাভাবের অন্ত বা শেষ নেই।
(গ) অত্যন্তাভাবঃ কোন একটি বস্তুতে অন্য একটি বস্তুর চিরকালের অভাবকে অত্যন্তাভাব বলা হয়। অত্যন্তভাব ত্ৰৈকালিক বা তিন কালের অভাব - অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতেও থাকে। অত্যন্তভাব অনাদি ও অনন্ত অর্থাৎ এই অভাবের আদি বা আরম্ভ নেই , অন্ত বা শেষ নেই। যেমন, বায়ুতে বর্ণের অভাব অত্যন্তভাব , যা তিন কালেই থাকে । খরগােশে শিঙের অভাব চিরকালের। ঘটেতে চেতনার অভাব চিরদিনের।
অনন্যান্যাভাব : দুই বস্তুর পারস্পরিক ভেদ বা ভিন্নতাই অন্যোন্যাভাব । যেমন, ঘট পট নয়। ঘটের মধ্যে পটের রূপ থাকতে পারে না। অন্যোন্যাভাব হল ঘটে পটের অভাব, পটে ঘটের অভাব। সংসৰ্গাভাব বলতে বােঝায় দুই বস্তুর মধ্যে সংযােগের অভাব, অন্যোন্যাভাব বলতে বােঝায় দুই বস্তুর মধ্যে অভিন্নতার অভাব। অন্যোন্যাভাব নিত্য। অন্যোন্যাভাবের আদি নেই, অন্তও নেই।
অভাবকে কিভাবে জানা যায়? : অভাব বিষয়ক একটি সুচিন্তিত প্রশ্ন : অভাবকে কিভাবে জানা যায়? ন্যায় - বৈশেষিকগণ এই প্রশ্নের উত্তরে বলেন যে, প্রত্যক্ষে দ্বারাই অভাবকে জানা যায় । তর্ক সংগ্রহে অন্নমভট্ট এরকম বক্তব্য রেখেছে যে, অভাবের প্রত্যক্ষ বহু সময় যে কোন একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ — ভূতলে ঘটাভাব প্রত্যক্ষ করছি, এই প্রত্যক্ষ কোন সন্নিকর্য নির্ভরশীল। এখন মনে হতে পারে, সন্নিকর্যটি কি যার উপর অভাব - জ্ঞানের নির্ভরতা? ন্যায় - বৈশেষিকগণ এর উত্তর দিয়েছেন এভাবে যে, ‘বিশেষণ - বিশেষ্য - ভাব' হল ঐ সন্নিকর্ষ। ভূতলে ঘটাভাব প্রত্যক্ষ করার সময় ভূতলের সঙ্গে চক্ষু - ইন্দ্রিয় সংযুক্ত হয়, যে ভূতল ঘটাভাবের দ্বারা বিশেষিত। সুতরাং চক্ষু - ইন্দ্রিয় ও ঘটাভাবের মধ্যে সম্পর্ককে ‘যার সঙ্গে সংযুক্ত তার বিশেষণতা' বলা হয়। এই বিশেষণতাই হল 'সংযুক্ত বিশেষণতা'।
‘ভূতলে ঘটাভাব' — এখানে ভূতল ‘বিশেয্য' এবং ঘটাভাব ‘বিশেষণ'। সুতরাং ভূতলে ঘটাভাব প্রত্যক্ষ করার বিষয়ে উভয়ের সম্বন্ধ হল ‘বিশেষণ - বিশেষ্য - ভাব'। অভাব প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ন্যায় - বৈশেষিকগণ এইভাবে ‘বিশেষণতা’ নামক যষ্ঠ প্রকার সন্নিকর্যের স্বীকৃতি দিয়ে বক্তব্য রাখলেন যে, অভাব জ্ঞানের উৎস হল প্রত্যক্ষ বা অভাবকে প্রত্যক্ষের দ্বারাই জানা যায়।
ভাট্ট মীমাংসকগণ উপরিউক্ত মতের বিরােধিতা করে বলেছেন যে, প্রত্যক্ত অভাবের জ্ঞানে প্রমাণস্বরূপ নয় বা অভাব কখনও প্রত্যক্ষের বিষয় নয়। এর কারণ হল: প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর সঙ্গে ইন্দ্রিয় - সন্নিকর্ষ নিশ্চিতভাবে ঘটে, কিন্তু কোন অভাবের সঙ্গে ইন্দ্রিয় - সন্নিকর্ষ বা সংযােগ ঘটে না । ভাট্ট মতে, অভাবকে জানা গেলেও অভাব জ্ঞানের উৎস হল অনুপলব্ধি। যখন আমরা বিছানার উপর বালিশের অভাবের কথা বলি, তখন আমরা কেবল বিছানাই প্রত্যক্ষ করি, বালিশ প্রত্যক্ষ করি না। কাজেই বালিশের অভাব হল অনুপলব্ধির বিষয়। অবশ্য এই অনুপলব্ধিকে যােগ্য হতে হবে, তা না হলে প্রমাণরূপে ধার্য হবে না। ভাট্ট মতে, শুধুমাত্র যােগ্যানুপলব্ধিই হল অভাব জ্ঞানের প্রমাণস্বরূপ।
ন্যায় বৈশেষিক দার্শনিকগণ যােগ্যানুপলব্ধিকে স্বীকার করেন। অনুপলব্ধি অভাব জ্ঞানের ক্ষেত্রে সহায়ক হলেও যে আধারের মধ্যে কোন বিষয়ের অভাব নিহিত, সেই আধার বা আশ্রয়ের সঙ্গে আমাদের ইন্দ্রিয় - সন্নিকর্য নিশ্চিতভাবে বর্তমান থাকে। সুতরাং অভাব জ্ঞানের মধ্যে ইন্দ্রিয়ের সংযােগ অপরিহার্য বলেই ইন্দ্রিয়ই অভাবের মুখ্য প্রমাণ-স্বরূপ। অবশ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে যােগ্যানুপলব্ধির সহকারিত্ব অভাব - জ্ঞানের জন্য নিশ্চয়ই থাকবে। কাজেই ন্যায় - বৈশেষিক মতে, অভাব প্রত্যক্ষের বিষয় অর্থাৎ প্রত্যক্ষের সাহায্যেই অভাবকে জানা যায়।
1 comments:
Sir apnar ektu mobile number dile valo hoto ami apnake ektu call kortam darkar chilo na hole amay ektu call korben
9083935275
Post a Comment