Sunday, 13 December 2020

ব্যাপ্তি কাকে বলে? কিভাবে নৈয়ায়িকগণ ব্যাপ্তি প্রমাণ করেন? (What is Vyapti? What is the Naya method of establishing it?)

2 comments

                             ন্যায় দর্শন

প্রশ্ন:  ব্যাপ্তি কাকে বলে? কিভাবে নৈয়ায়িকগণ ব্যাপ্তি প্রমাণ করেন? (What is Vyapti? What is the Naya method of establishing it?)

উঃ

ব্যাপ্তি: হেতু ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ত অব্যভিচারী অনৌপাধিক সহচার সম্বন্ধকে ব্যাপ্তি বলা হয়। অন্নভট্ট তাঁর ‘তর্ক সংগ্রহ' গ্রন্থে ব্যাপ্তি সম্পর্কে বলেছেন— “যত্র ধূমঃ তত্র অগ্নি ইতি সাহচৰ্য্য নিয়মঃ ব্যাপ্তি।” অর্থাৎ যেখানেই ধূম সেখানেই বহ্নি, এই যে ধূমের সঙ্গে বহ্নির সাহচর্য বা সহ - অবস্থান, তার নিয়মই ব্যাপ্তি। ধুম (হেতু) ও বহ্নি (সাধ্য) -র মধ্যে এই ব্যাপ্তি সম্বন্ধে (ক) ধূম ও বহ্নি সহচার সম্বন্ধে আবদ্ধ, অর্থাৎ ধূম ও বহ্নি একসঙ্গে সহাবস্থান করে, (খ) ধূম ও বহ্নির মধ্যে অব্যভিচারী সম্বন্ধ আছে, অর্থাৎ ধূম আছে অথচ, বহ্নি নেই, এরকম হতে পারে না এবং  গ) ধূম ও বহ্নির মধ্যে অনৌপাধিক সম্বন্ধ বিদ্যমান, অর্থাৎ উভয়ের সম্বন্ধ কোন শর্ত - নির্ভর নয়। ব্যাপক অর্থে ব্যাপ্তি হলেও বােঝায় যে কোন দুটি বিষয়ের নিয়ত সাহচর্য। সংকীর্ণ অর্থে ব্যাপ্তি বলতে বােঝায় হেতু ও সাধ্যের নিয়ত সাহচর্য সম্পর্ক।

        ব্যাপ্তির প্রকার: ব্যাপ্তি দু'প্রকার — (১) সমব্যাপ্তি ; (২) অসমব্যাপ্তি বা বিষয়ব্যাপ্তি ।

      (১) সমব্যাপ্তি : সমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে সমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান হয়। যেমন, 'যার উৎপত্তি আছে, তার বিনাশ আছে'। উৎপত্তি হওয়া বস্ত্ত ও বিনাশ হওয়া বস্তুর বিস্তৃতি সমান। উৎপত্তিশীল ও বিনাশশীল সমব্যাপ্তি - বিশিষ্ট।

(২) অসমব্যপ্তি বা বিষমব্যাপ্তি: অসমব্যাপক দুটি পদের ব্যাপ্তিকে অসমব্যাপ্তি বলা হয়। এখানে ব্যাপক ও ব্যাপ্য-র বিস্তৃতি সমান নয়। যেমন, যেখানে ধূম আছে, সেখানে বহ্নি আছে। ধূম ও বহির বিস্তৃতি সমান নয়। ধূম থাকলে বহ্নি থাকবেই। কিন্তু যেখানে বহ্নি, সেখানে সব সময় ধূম নাও থাকতে পারে। তাহলেই বহ্নির বিস্তৃতি ধূমের চেয়ে ব্যাপক। তাই দুটি পদের ব্যাপকতা যেখানে ভিন্ন, এই ব্যাপ্তি হল অসমব্যাপ্তি বা বিষয়ব্যাপ্তি।

       সাধারণত নৈয়ায়িকগণ নিম্নলিখিত উপায়ে ব্যাপ্তি নির্ণয় করেন ।

     (১) অন্বয়: দুটি বস্তুর একটি থাকলে অপরটি থাকে লক্ষ্য করা যায়। যেমন, 'যেখানে ধূম, সেখানে বহ্নি'। দুটি বস্তুর একসঙ্গে উপস্থিতি হল অন্বয়। 

    (২) ব্যতিরেকঃ দুটি বস্তুর একটি যদি না থাকে, অপরটি থাকে না। যেমন, যেখানে বহ্নি নেই, সেখানে ধূম নেই। দুটি বস্তুর একসঙ্গে অনুপস্থিতি হল ব্যতিরেক। অন্বয় ও ব্যতিরেক - এর দিক থেকে দুটি বস্তুর মধ্যে সাহচর্য থাকা দরকার, তা না  হলে দুটি বস্তুর মধ্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

    (৩) ব্যভিচারাগ্ৰহ: ব্যাপ্তি নির্ণয় প্রণালীর তৃতীয় স্তরে আমরা ব্যভিচারাগ্রহ পাই, যখন কোন বিপরীত দৃষ্টান্ত প্রত্যক্ষ করি না। অন্বয় ও ব্যতিরেক - এর দ্বারা যে দুই বস্তুর মধ্যে নিয়মিত সহচার সম্বন্ধ আছে মনে করা হয়, সেক্ষেত্রে এমন কোন ব্যভিচার (ব্যতিক্রম - দর্শন) হবে না, সেক্ষেত্রে একটি বস্তু উপস্থিত আছে, অথচ অন্য বস্তু অনুপস্থিত থাকে। দুটি বস্তুর একটি আছে, অথচ অপরটি নেই, এমন কোন দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। যেমন, ধূম আছে, অথচ বহ্নি নেই, এমন কোন দৃষ্টান্তের নজির নেই। একে ব্যভিচারাগ্রহ (ব্যভিচার মানে বিপরীত দৃষ্টান্ত; অগ্ৰহ মানে অদর্শন) বলা হয়। এই স্তর অবধি দেখে আমরা ভাবতে পারি যে, ধূম ও বহ্নির ব্যাপ্তি সম্বন্ধ আছে। কিন্তু এই সম্বন্ধ অনৌপাধিক না উপাধিযুক্ত দেখা দরকার, কেননা উপাধিযুক্ত সম্বন্ধকে ব্যাপ্তি বলা যায় না।

     (৪) উপাধিনিরাস : উপরােক্ত তিনটি পদ্ধতি অবলম্বন করেও নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, ব্যাপ্তি - সম্বন্ধটি কোন উপাধি বা শর্ত থেকে মুক্ত কিনা। তাই সম্বন্ধটি যে অনৌপাধিক বা শর্তশূন্য এবিষয়ে আমরা স্থির হতে চাই। সেজন্য আমরা উপাধি নিরাস করতে অগ্রসর হই। 'উপাধি' শব্দটির অর্থ শর্ত এবং 'নিরাস’ শব্দটির অর্থ অপসারণ করা। নৈয়ায়িকগণ মনে করেন, ব্যাপ্তিসম্বন্ধ হল উপাধিহীন বা শর্তহীন সম্বন্ধ। তাই নৈয়ায়িকগণ বলেন, আমাদের প্রত্যক্ষিত বিষয় দুটির মধ্যে উপাধিহীন সম্বন্ধ আছে কিনা তা জানার জন্য ভুয়ােদর্শন প্রয়ােজন। একটির উপস্থিতিতে আর একটি উপস্থিত আছে এবং একটির অনুপস্থিতিতে আর একটি  অনুপস্থিত আছে — এ সম্বন্ধ বারবার প্রত্যক্ষ করার নাম ভূয়ােদর্শন। যদি বার বার দেখা যায়, ধূম থাকলেই বহ্নি থাকে এবং বহ্নি না থাকলে ধূম থাকে না, তখন আমরা মনে করি - ধূমের সঙ্গে বহ্নির যে সম্পর্ক তা হল উপাধি বা শর্তশূন্য । 

উপাধিনিরসন পদ্ধতির সাহায্যে ব্যাপ্তি নির্ণয় সত্ত্বেও সংশয়বাদীরা সংশয় প্রকাশ করতে পারেন এবং বলতে পারেন যে, ভবিষ্যতে এই নিয়ত সম্পর্কের ব্যতিক্রম হতে পারে। তাই সংশয়বাদীদের সন্দেহ ভঞ্জন করার জন্য নৈয়ায়িকগণ তর্ক ও সামান্যলক্ষণ প্রক্রিয়ার ব্যবহার করেছেন। 

       (৫) তর্ক: ব্যাপ্তি - সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার জন্য নৈয়ায়িকগণ তর্কের সাহায্য গ্রহণ করেন। তর্ক হল এমন এক পদ্ধতি যার দ্বারা মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের বিরুদ্ধ বচনকে  অসত্য প্রমাণ করে মূল বাক্যের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। 'সকল ধূমবান বস্তুই বহ্নিমান’ – যদি এই বচনটি সত্য না হয়, তাহলে এর বিরুদ্ধ বচন ‘কোন কোন ধূমবান বস্তু বহ্নিমান নয়’– নিশ্চয়ই সত্য হবে। তা যদি হয়, তাহলে বহ্নি বা আগুন ছাড়াও ধূম উৎপন্ন হবে। কিন্তু এরূপ অনুমান সর্বজনস্বীকৃত কার্যকারণ - নীতির বিরােধী। কেননা, বহ্নি ছাড়া ধূমের অন্য কোন কারণ আমাদের জানা নেই। যদি বহ্নি ছাড়া ধূম উৎপন্ন হয়, তাহলে তার তাৎপর্য হবে — কারণ ছাড়াই কার্য ঘটতে পারে। কিন্তু এরূপ বক্তব্য কোন মানুষের কাছেই গ্রহণযােগ্য নয়। কাজেই ‘কোন কোন ধূমবান বস্তু বহ্নিমান নয়’ - এই বচনটি অসত্য বলে এর বিরুদ্ধ বচন, অর্থাৎ , মূল ব্যাপ্তি বচন 'সকল ধূমবান বস্তুই বহ্নিমান' - সত্য বলে স্বীকৃত হবে।

     (৬) সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ:  ব্যাপ্তিজ্ঞানের সমস্তু সংশয় দূর করার জন্য নৈয়ায়িকেরা সর্বশেষে সামান্যলক্ষণ প্রত্যক্ষের কথা বলেছেন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যখন আমরা ধূমের সঙ্গে বহ্নির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ করি, তখন আমরা ধূমের সামান্যধর্ম ধূমত্বকে এবং বহ্নির সামান্যধর্ম বহ্নিত্বকে প্রত্যক্ষ করি; এবং সেই সময় ধূমত্বের সঙ্গে বহ্নিত্বের সম্পর্কও প্রত্যক্ষ করে থাকি। 'বিশেষ’ - এর মধ্যে সামান্য বা জাতিধর্মকে অলৌকিকভাবে প্রত্যক্ষ করার নাম সামান্য - লক্ষণ প্রত্যক্ষ। ধূমত্ব এবং বহ্নিত্বের মাধ্যমে আমাদের সমস্ত ধূম এবং সমস্ত বহ্নির প্রত্যক্ষ হয় বলে আমরা 'সকল ধূমবান বস্তুই বহ্নিমান ’ -- এরূপ ব্যাপ্তি - জ্ঞানবাক সামান্য বচন প্রতিষ্ঠা করতে পারি। কাজেই দুটি জিনিষের অব্যভিচারী নিয়ত অনৌপাধিক সম্পর্ক বা ব্যাপ্তি নিশ্চিতভাবে স্থাপন করতে হলে দুটি জিনিসের সহচার সম্পর্কের কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখলেই চলবে না, এই দৃষ্টান্তের মধ্য থেকে দুটি জিনিসের সামান্যও প্রত্যক্ষ করতে হবে।

 

If You Enjoyed This, Take 5 Seconds To Share It